নাক কুঁচকাল কিশোর। মিথ্যে বলছে। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। কিন্তু কেন? কি লুকানোর চেষ্টা করছে?
পাঁচ
লিভিংরুমে ফিরে দেখা গেল, বিজ্ঞানীদের একজনও নেই। সোফার কভার ঝেড়ে, সোজা করছে মোটা এক মহিলা। কালোচুল এক তরুণ জানালা-দরজার কাঁচ মোছায় ব্যস্ত।
অ, লিলি, মহিলা বলল। তোমার বন্ধু নাকি? ভাল।
মহিলাকে চিনল কিশোর। মিসেস গ্যারেট। মাথায় এখন একটা ছাই-সোনালি উইগ। তবে চোখের পাপড়ি আগেরগুলোই আছে।
ছেলেদের সঙ্গে মহিলার পরিচয় করিয়ে দিল লিলি।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, কিশোরের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বিচিত্র শব্দ করল মিসেস গ্যারেট, ছানাকে আদর করার সময় মুরগী যেমন কঁক-কঁক করে অনেকটা তেমনি। তুমি সেই ছেলেটাই তো। খুব ভাল ছেলে। মানুষের খারাপ সময়ে যে উপকার করে সে-ই তো ভাল মানুষ। জানো, তখন হাসপাতালে হালের কথা খুব মনে পড়ছিল। ও, হাল কে চেনো না? হাল গ্যারেট। আমার স্বামী, শেষ স্বামী। ওর মত মানুষই হয় না।
বকবক করে চলল মিসেস গ্যারেট।
কয়েক মিনিটেই জানা হয়ে গেল ছেলেদের, মোট তিনজন স্বামী বদল করেছে মহিলা। প্রথমজন ছিল বীমার দালাল, দ্বিতীয়জন চিত্রপরিচালক, আর তৃতীয়জন, তার পছন্দের মানুষ এবং শেষ স্বামী-একজন পশুচিকিৎসক।
সব মানুষই ভাল হয় না, বলে গেল মিসেস গ্যারেট, সবাই বাঁচে না বেশিদিন। আমার স্বামীদের বেলায়ও তাই হয়েছে। কম বয়েসে মারা গেল। তারপর এসে এখানে হাউসকীপারের চাকরি নিলাম। ডাক্তারগুলোকে প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম, একেকজনের একেক রকম স্বভাব, অদ্ভুত। আবোলতাবোল বকে, আর সুযোগ পেলেই বসে বসে গালে হাত রেখে ভাবে। বলো দেখি কি কাণ্ড! তবে একবার ওদের স্বভাব বুঝে ফেললে আর কোন অসুবিধে নেই। বলে একটা, করে আরেকটা। ডাক্তার রুডলফের কথাই ধরো। মুখে নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা, খুন এসব ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অথচ একটা মাছি মারতে পারবে না, মারলে কেঁদে বুক ভাসাবে। ডাক্তার হ্যারিসন হয়েছে। তার উল্টো। খুনটুন এসব কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। অথচ যা বদমেজাজী, মানুষ খুন করতেও হাত কাঁপবে বলে মনে হয় না।…লিলি, ওকে তোমার আংকেলের সামনে বেশি যেতে দিও না। কখন যে কি ঘটাবে কে জানে।
আমি বুঝি, মিনমিন করে বলল লিলি।
কাজে মন দিল আবার মিসেস গ্যারেট।
ভেজা ব্রাশ বালতির পানিতে ফেলে ঘুরে দাঁড়াল তরুণ। লিলিকে বলল, আমার সঙ্গে পরিচয় করালে না? এগিয়ে এল।
লজ্জা পেল লিলি। ও, হ্যাঁ, কিশোর, ওর নাম বিল উইলিয়ামস। সেন্টারে কাজ করে, আমার মত।
হেসে হাত বাড়িয়ে দিল বিল। হাই। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।…লিলি, গতরাতের জন্যে আমি লজ্জিত। টায়ার পাংচার হয়ে আটকে গিয়েছিলাম…আমার জন্যে বেশি অপেক্ষা করোনি তো?
ওসব কথা থাক, বলে ছেলেদের নিয়ে আরেকটা দরজার দিকে রওনা হলো লিলি।
লাইব্রেরিতে ঢুকল ওরা। তারপর ছোট একটা চৌকোনা ঘর পার হয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির একপ্রান্তে।
ওখান থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে আস্তাবল। নীরবে সেদিকে এগোল লিলি।
প্রিয় ঘোড়াটার কাছে এসে মেজাজ ভাল হয়ে গেল তার। ঘোড়ার নাম রেখেছে পাইলট। মুসার বেশ পছন্দ হলো নামটা।
গলায় হাত বোলাতে বোলাতে নিচু স্বরে ওটার সঙ্গে কথা বলল লিলি। চারটে আপেল মাটিতে রেখে জিজ্ঞেস করল, ক-টা?
চারবার পা ঠুকল ঘোড়াটা।
লক্ষ্মী ছেলে, বলে চারটে আপেলই পাইলটকে উপহার দিয়ে দিল লিলি।
আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লিলি রইল ভেতরে, ঘোড়ার সেবাযত্ন শেষ হতে সময় লাগবে।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে শহরের দিকে চলল ছেলেরা, খিদে পেয়েছে।
রাস্তায় লোকের ভিড় আরও বেড়েছে। স্ন্যাকসের দোকানের সামনে এসে লাইন দিতে হলো তাদের। সাধারণ হ্যামবার্গার জোগাড় করতেই লেগে গেল এক ঘণ্টার বেশি।
খাওয়া সেরে শহর দেখতে চলল। দোকানিদের দম ফেলার অবকাশ নেই। আগামী দিন গুহামুখ খুলে দেয়া হবে। পিঁপড়ের মত পিলপিল করে বাইরে থেকে আসছে লোক। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সব ক-জন দোকানি। তার ওপর রয়েছে দোকান সাজানোর কাজ। কয়েকটা দোকানের সামনের কাছে বড় করে আঁকা হয়েছে গুহামানবের ছবি, পরনে পশুর ছাল, হাতে মুগুর। একটা দোকানের ছবি তো আরেক কাটি বাড়া। চুল ধরে এক গুহামানবীকে টেনে নিয়ে চলেছে ভয়ানক চেহারার এক উন্মত্ত গুহামানব। প্রায় সমস্ত দোকানের সামনেটাই রঙিন কাগজের ত্রিকোণ পতাকা কেটে সাজানো হয়েছে।
গুহামুখ খোলার অনুষ্ঠান হবে ছোট পার্কটায়। তাই রঙিন বাল্ব দিয়ে সাজানো হচ্ছে গাছগুলোকে। স্ট্যাণ্ডগুলোয় নতুন করে রঙ করা হচ্ছে। অটোমেটিক স্পৃিঙ্কলার সিসটে আছে একটা, নিদিষ্ট সময়ে ওটার ঝাঁঝরিগুলোর মুখ খুলে যায়, বৃষ্টির মত পানি ঝরে পড়ে পার্কের গাছপালার ওপর।
পুরানো রেলস্টেশনের কাছে আস্তানা গেড়েছে এক আইসক্রীম। ফেরিওয়ালা। ছোট ট্রাকে করে আইসক্রীম এনেছে। ভাল বিক্রি।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ম্যাকম্বারের গোলাবাড়িতে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।
সেখানেও উত্তেজনা।
লম্বা, রগ বের হওয়া একজন লোক তার ওঅভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে কাজে ব্যস্ত, যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে করতে বিড়বিড় করছে আপনমনে। ঠিক হচ্ছে না। মোটেই উচিত হচ্ছে না। পস্তাবে, দেখো, পস্তাবে বলে দিলাম।