গেট খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। সদর দরজায় কোন পাহারা নেই। পাল্লায় টোকা দেয়ারও প্রয়োজন মনে করল না লিলি, ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল।
কোন এনট্রি হল নেই। বড় একটা লিভিং রুমে সরাসরি এসে ঢুকল ওরা। ঘরেই আছেন জর্জ হ্যারিসন। পায়চারি করছিলেন, ওদের দেখে থামলেন।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল লিলি।
ভ্রুকুটি করলেন ডাক্তার। ও, তোমরাও ভণ্ডামী দেখতে এসেছ?
গুহামানবকে দেখতে, স্যার, জবাব দিল মুসা!
কি যে কাণ্ড! পাগল হয়ে গেছে লোক! আবার পায়চারি শুরু করলেন হ্যারিসন। দলে দলে আসবে। মাড়িয়ে শেষ করে দিয়ে যাবে সবকিছু। পাহাড়ের নিচে নিশ্চয় আরও ফসিল আছে। আমার বন্দুক থাকলে…
সব্বাইকে গুলি করে মারতে, বলল শান্ত একটা কণ্ঠ।
ঘুরে তাকাল ছেলেরা।
লম্বা, বিষণ্ণ চেহারার একজন লোক ঘরে ঢুকেছেন। কঙ্কালসার দেহ। কিশোর চিনল। রকি বীচ হাসপাতালে দেখেছে। সেদিন পরেছিলেন মলিন একটা ধূসর স্যুট। আজ পরনে রঙচটা খাকি হাফপ্যান্ট আর পোলো শার্ট। ফায়ারপ্লেসের ধারে একটা আর্ম-চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইলেন নিজের হাড়সর্বস্ব হাঁটুর দিকে।
ডাক্তার রুডলফ, লিলি বলল, কিশোর পাশার সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় আছে?
অবাক হলেন ডাক্তার। আছে কি?
রকি বীচ হাসপাতালে যেদিন মারা গেলেন ডাক্তার ক্লডিয়াস, লিলি মনে করিয়ে দিল, আমাকে সাহায্য করেছিল ও। আপনি যখন ঢুকলেন তখনও ছিল। মনে নেই?
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, হাসলেন ডাক্তার। হাসলে তার বয়েস কম মনে হয়। কেমন আছ?
ভাল, মাথা কাত করল কিশোর।
ডাক্তার রুডলফও আর্কিওলজিস্ট, লিলি জানাল। একটা বই লিখছেন।
আবার হাসলেন ডাক্তার।
আল ম্যানও তো আপনারই লেখা, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওপরে উঠে গেল রুডলফের ভুরু। তুমি ওটা পড়েছ?..
হ্যাঁ। লাইব্রেরিতে পেয়েছিলাম। দারুণ লেখা, তবে মন খারাপ হয়ে যায়। এভাবে সব সময়ই যদি মানুষকে মানুষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়…
খুব খারাপ, তাই না? কিশোরের বাক্যটা শেষ করলেন রুডলফ। জন্ম থেকেই আমরা নিষ্ঠুর, পৈশাচিকতা ভালবাসি। সেটাই আমাদের, মানে মানুষের বৈশিষ্ট্য। বড় মগজ থাকায় আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারি। বলে এসব করার সুবিধে হয়েছে।
ফালতু কথা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার হ্যারিসন। ভায়োলেন্স মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়, জন্ম থেকে নিষ্ঠুর হয় না মানুষ। সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছ তুমি।
তাই নাকি? বাঁকা চোখে সহকারীর দিকে তাকালেন রুডলফ। বেশ, ডেনি গ্যাসপারের কথাই ধরা যাক। মানুষের উন্নতি চাইতেন তিনি, তার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এই গ্যাসপার সেন্টার; কিন্তু তাই বলে কি তাঁকে নিষ্ঠুর বলা যাবে না? নিশ্চয় যাবে। রীতিমত খুনী ছিলেন। বিগ-গেম হান্টার ছিলেন। শিকার মানেই খুন, আর খুন মানেই পৈশাচিকতা, কিংবা ভায়োলেন্স, যা-ই বলো। ম্যানটেলপিস-এর দিকে দেখালেন। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে শিংওয়ালা একটা জন্তুর স্টাফ করা মাথা, মৃত চোখদুটো চেয়ে আছে জানালার দিকে। কয়েকটা বুককেসের ওপরের দেয়ালে সাজানো রয়েছে বাঘ, পুমা আর একটা বিশাল জলমহিষের মাথা। ভালুক, সিংহ আর চিতার চামড়া আছে। কয়েকটা। এখন যুগ পাল্টেছে, তাই মানুষের পরিবর্তে জন্তু শিকার করে তার মাথা কিংবা চামড়া এনে ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়। বহুকাল আগে কি হত? অন্য কোন শিকার না পাওয়া গেলে মানুষ মানুষকেই মারত। আমরা যেমন মুরগীর ঠ্যাঙ চুষি, তেমনি করে মানুষের হাড় চুষত সে-কালের মানুষেরা।
সব গুবলেট করে ফেলছ! খেঁকিয়ে উঠলেন হ্যারিসন।
তারমানে ঠিকই বলছি, হাত তুললেন রুডলফ। তোমার রেগে যাওয়া মানেই, নিজের যুক্তির স্বপক্ষে জবাব খুঁজে না পাওয়া।
ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকলেন টাকমাথা, ছোটখাটো একজন মানুষ। আবার শুরু করেছ! নাহ্, তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না। মানুষ নিষ্ঠুর হোক বা না হোক তাতে কি এসে যায়?
আগন্তুকের পরিচয় দিল লিলি, ইনি ডাক্তার এনথনি রেডম্যান, ইমিউনোলজিস্ট। অনেকগুলো সাদা ইঁদুর আছে ওঁর।…স্যার, এদেরকে ওগুলো দেখাতে চাই। দেখাব?
দেখাও, তবে হাত দিতে পারবে না, অনুমতি দিলেন ডাক্তার রেডম্যান।
না, দেব না।
আরেকটা হলরুমে ঢুকল ছেলেরা।
ওঅর্করুম, ল্যাবরেটরি, সব জায়গায়ই যাওয়া যায় এখান থেকে। ওই যে, একটা দরজা দেখাল লিলি, ওটার ওপাশে ডাক্তার রেডম্যানের ল্যাবরেটরি।
দরজা ঠেলে ছোট একটা ওয়াশরুমে ঢুকল ওরা। চারটে সার্জিক্যাল মাস্ক বের করে একটা নিজে নিয়ে বাকি তিনটে তিনজনকে দিল লিলি। পরে নাও। মাস্ক মুখে লাগিয়ে ভারি একজোড়া রবারের দস্তানা পরে নিল সে।
দেখাদেখি তিন গোয়েন্দাও মুখোশ পরল।
আরেকটা দরজা ঠেলে বড় একটা ঘরে এসে ঢুকল ওরা। রোদের আলোয় আলোকিত। দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে সারি সারি কাঁচের খাঁচা। ভেতরে অসংখ্য সাদা প্রাণী ছুটাছুটি করছে।
বেশি কাছে যেয়ো না, সাবধান করল লিলি, ছুঁয়ো না। ইঁদুরগুলোকে খাওয়ানোয় মন দিল সে।
এগুলো বিশেষ ধরনের ইঁদুর, খানিক পরে আবার বলল। ওদের ইমিউনিটি নষ্ট করে দিয়েছেন ডাক্তার রেডম্যান…
এক মিনিট, হাত তুলল মুসা। ইমিউনিটিটা কি?
এক কথায় ব্যাখ্যা করা যাবে না, বলল রবিন। রোগ-প্রতিরোধ। ক্ষমতা জাতীয় কোন ব্যাপার।