ডাক্তার হ্যারিসনের সঙ্গে এসেছেন মিস্টার কিংসলে ম্যাকম্বার, আবার বলল এলান ফিউজ। ব্যবসা করেন। সাইট্রাস গ্রোভে তাঁর জমিতেই কঙ্কালটা পাওয়া গেছে। এ রাইট! রুক্ষকণ্ঠে বলে উঠলেন বিজ্ঞানী। ব্যবসায়ীই। লোকের গলা কেটে টাকা নেয়।
অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বলল এলান ফিউজ, ডাক্তার হ্যারিসন এখন আমাদেরকে ফসিলটার কথা কিছু বলবেন।…কোথায়। পেয়েছেন, স্যার? কিভাবে?
চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ। নেহাত ভাগ্যের জোরেই পেয়েছি বলা যায়। হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। বৃষ্টি সবে থেমেছে তখন। পথের ধারে একফালি জমি, তার পরে পাহাড়। বৃষ্টিতে ঢালের মাটির আস্তর ধুয়ে উঠে গেছে, একটা গর্তের ভেতর থেকে সাদামত কি যেন বেরিয়ে আছে দেখলাম। অন্ধকার হয়ে এসেছে তখন…
তোমার আগেই আমি দেখেছি, বাধা দিয়ে বলল ম্যাকম্বার। আমি দেখার পর…
স্পষ্ট দেখা যায় না, ম্যাকম্বারের কথা না শোনার ভান করে আবার আগের কথার খেই ধরলেন ডাক্তার, আলো দরকার। টর্চ আনতে গেলাম সেন্টারে।
এসে দেখলে শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছি আমি, বলল ম্যাকম্বার। ভাগ্য ভাল, বেশি গোলমাল করোনি, নইলে…
লম্বা করে শ্বাস টানলেন হ্যারিসন। ধৈর্য রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ওর জায়গা, তাই ওকে সঙ্গে নিয়েই গেলাম। মুখের ঠিক ভেতরেই পড়ে আছে ওটা, কাদায় দেবে আছে বেশির ভাগ। খুলি দেখেই বুঝলাম
পুরানো! চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। অনেক পুরানো! হাজার হাজার বছর আগের!
খুলিটার কাছেই ছিল অন্যান্য হাড়, প্রায় পুরো কঙ্কালটাই ছিল, বলে চললেন হ্যারিসন। ভালমত পরীক্ষা করে দেখতে পারিনি এখনও। তবে, আফ্রিকায় যেসব পুরানো ফসিল পাওয়া গেছে, সেগুলোর সাথে অনেক মিল আছে।
কঙ্কালটা কি মানুষের? জিজ্ঞেস করল ফিউজ।
কপালে ভাঁজ পড়ল বিজ্ঞানীর। আধুনিক মানুষের সঙ্গে অনেক মিল আছে বটে। তবে, পুরোপুরি মানুষ বোধহয় বলা যায় না। আমেরিকায় এ যাবৎ যত হোমিনিড পাওয়া গেছে তার মধ্যে এটা সবচেয়ে পুরানো।
সামনে ঝুঁকলেন হ্যারিসন। বলা হয়, আজকের আমেরিকান ইনডিয়ানরা আদিম মংগোলিয়ান যাযাবরদের বংশধর। বরফ যুগের শেষ দিকে সাইবেরিয়া আর আলাসকা থেকে এসেছিল ওরা। আট থেকে দশ হাজার বছর আগে। বেশির ভাগ সাগরের পানিই জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল সে-সময়, সমুদ্র সমতল ছিল অনেক নিচে। সাইবেরিয়া আর আলাসকার মাঝে দূরত্ব এত কমে গিয়েছিল, পা বাড়ালেই এক দেশের মানুষ আরেক দেশে ঢুকে পড়তে পারত। আর তা-ই করেছিল এশিয়ান যাযাবরেরা। শিকার করতে করতে চলে এসেছিল নতুন দেশে। শিকার পাওয়া যেত বেশি, তাই আর ফিরে যায়নি ওরা, ছড়িয়ে পড়ে বিশাল অঞ্চলে। কেউ কেউ চলে যায় একেবারে দক্ষিণ আমেরিকার শেষ মাথায়।
এসবই অবশ্য বিজ্ঞানীদের অনুমান। কেউ কেউ অন্য কথাও বলেন। বরফ যুগের আগে থেকেই নাকি আমেরিকায় মানুষ ছিল। কেউ তো আরও বাড়িয়ে বলে আনন্দ পান। বলেন মানুষের আদি জন্ম এই আমেরিকাতেই, পরে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে গেছে। দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে ইউরোপ, এশিয়ায়।
সাইট্রাস গ্রোভে পাওয়া ফুসিলটা কি প্রমাণ করে? জিজ্ঞেস করল ফিউজ।
এখুনি কিছু বলা যাবে না। কত পুরানো, তা-ই জানা হয়নি। আমাদের এই কঙ্কালটা…
এখানে আমাদের কথাটা আসছে কিভাবে? ওটা তো শুধু আমার, গোঁয়ারের মত বলে উঠল ম্যাকম্বার। আমার জায়গায় পাওয়া গেছে। সন্দেহেরও কিছু নেই, ওটা মানুষেরই কঙ্কাল। লাখ লাখ বছর ধরে পড়ে আছে, এই একটু আগে যে হাজার হাজার বলেছে, বেমালুম ভুলে গেছে।
পাগল নাকি! আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না হ্যারিসন, ধমকে উঠলেন।
পাগলের কি আছে? গলা আরও চড়াল ম্যাকম্বার। বিজ্ঞানীদের সন্দেহ থাকতে পারে, কিন্তু আমি শিওর, এই আমেরিকাতেই প্রথম মানুষের জন্ম হয়েছিল। গুহায় যে পড়ে আছে, হয়তো ওটাই প্রথম মানুষ, ওরই বংশধর আমরা। গার্ডেন অভ ইডেন হয়তো সাইট্রাস গ্রোভের ধারেকাছেই কোথাও মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে। ব্যাকারসফিল্ড, কিংবা ফ্রেজনোতে…
অ্যাই, তুমি থামবে? হাত নাড়লেন হ্যারিসন।
কেন, ঠিক কথাই তো বলছি…
ঠিক! চেয়ার নিয়ে ঘুরে ম্যাকম্বারের মুখোমুখি হলেন ডাক্তার।
কি করে জানলে, ঠিক? স্টাডিই তো করলাম না…
করার দরকারও নেই। আর করতে দিচ্ছে কে তোমাকে? যেখানে পাওয়া গেছে ওটা, সেখানেই থাকবে, যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবে। মাইক্রোস্কোপের তলায় রাখা তো দূরের কথা, ছুঁতেও দেব না তোমাকে। তবে হ্যাঁ, লোকে দেখতে চাইলে অবশ্যই দেখাব।
সর্বনাশ! ফসিল নিয়েও ব্যবসা করবে নাকি? শশা দেখাবে? আমিও সেটি হতে দিচ্ছি না। কত পুরানো হাড় ওগুলো…
অনেক অনেক পুরানো, সেটা বুঝতে আর স্টাডি করার দরকার হয় না। দেখেই বলে দেয়া যায়। আমার ওই গুহায়ই জন্মেছিল প্রথম মানুষ, সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। আমাদের সবারই আদিপিতা ওই মানুষটি। তাকে দেখার অধিকার সব মানুষেরই আছে।
পয়সা লোটার মওকা পেয়েছ তো, এছাড়া কি বলবে, চামার কোথাকার! রাগে ফেটে পড়লেন হ্যারিসন। কি বলছ বুঝতে পারছ?
পারছি। সরাসরি ক্যামেরার চোখের দিকে তাকাল ম্যাকম্বার। ওটা পৃথিবীর প্রথম মানুষ, বাবা আদমের হাড়, নিশ্চয় আপনারাও বুঝতে পারছেন। আপনাদের সবারই দেখার অধিকার আছে। আমার গুহায় সবাই আমন্ত্রিত। তবে দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন, একটু সময় দিন আমাকে, জায়গাটাকে ঠিকঠাক করে রেডি করে ফেলি। তারপর গুহার মুখ খুলে দেব সবার জন্যে। ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা হবে