উঠে এসে কিশোরও হাত লাগাল।
ফোকরের ভেতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল মুসা। মাত্র দু-তিন ফুট নিচে মাটি। দেয়ালের বাকি অংশটা মাটির তলায়। সেটা বরং ভালই হলো ওদের জন্যে।
খুব সহজেই বেরিয়ে চলে এল ওরা।
সারা গায়ে ধুলো-ময়লা আর শ্যাওলা, ভূত সেজেছে যেন। একেকজন। হাতে-পায়ে আঁচড়ের দাগ, কোন কোনটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। লিলির চোখ লাল, কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছে চোখমুখ।
চলো, শয়তানটাকে ধরি গিয়ে, বলল লিলি। পালানোর আগেই। নইলে লোকের সর্বনাশ করবে সে। এফ-টোয়েন্টি থ্রির ফরমুলা এখন তার হাতে।
আরও ওষুধ বানিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়াবে ভাবছেন? বলল মুসা।
তাই তো করবে। ঘুম পাড়াতে পারলে কত কিছুই করা সম্ভব। পকেটের টাকা লুট করা থেকে শুরু করে অনেক কিছু..চলো, জলদি চলো।
বনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলল ওরা। বনের শেষে মাঠ পেরিয়ে গোলাবাড়িতে পৌঁছে দেখল, ম্যাকম্বারের গাড়িটা আছে। ইগনিশন কী লাগানোই আছে। পেছনের সীটে এক গাদা প্যাকেট, টিন। এইমাত্র বোধহয় মুদির দোকান থেকে এসেছে ম্যাকম্বার।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল লিলি। মোচড় দিল চাবিতে।
আরে, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমাদেরকেও নিয়ে যান, বলতে বলতেই একটানে পেছনের দরজা খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল মুসা। রবিনও উঠল। কিশোর উঠে বসেছে লিলির পাশে।
দরজায় দেখা দিল জেলডা ম্যাকম্বার। চেঁচিয়ে উঠল।
কিন্তু কানই দিল না লিলি। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। গীয়ার বদলে টান দিল গাড়ি। একটানে উঠে চলে এল পথের ওপর। ছুটে চলল শহরের দিকে।
যাচ্ছি কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল লিলির। গতি কমিয়ে মুখ ফেরাল কিশোরের দিকে, ভা-ভাবছি সেন্টারডেলে…
ওখানে গেছে বিল, কি করে জানলেন?
আর কোথায় যাবে… থেমে গেল লিলি। দ্বিধায় পড়েছে।
সামনে কোথাও গাড়ি রেখে আগে শেরিফকে ফোন করুন, রামর্শ দিল কিশোর। চোখ বন্ধ করে বার দুই চিমটি কাটল নিচের, ঠোঁটে। বিলের গাড়িতে যে খামটা দেখেছিল, সবুজ কালিতে তাতে লেখা ঠিকানাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। চোখ মেলল হঠাৎ। ওঅ্যাডলি! ওঅ্যাডলি রোডটা কোথায় জানেন?
সেন্টারডেলে। ইনডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায়।
তাহলে সেখানেই! চেঁচিয়ে উঠে দু-আঙুলে চুটকি বাজাল কিশোর। খামে আরেকটা নাম দেখেছি…হ্যাঁ, সাইনস সার্ভিস। নিশ্চয় কোন কেমিকেল কোম্পানির নাম। এফ-টোয়েন্টি থ্রি বানাতে কেমিকেল দরকার। যেহেতু নাড়া একটা পড়েছে, আমরা জেনে গেছি, অনেক বেশি ওষুধ বানিয়ে এখন হাতে রাখতে চাইবে সে, পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে।…সে বানাতে জানে তো?
জানে, জবাব দিল লিলি। কলেজে কেমিস্ট্রি ছিল।
তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই। সেন্টারডেলেই গেছে সে। তাড়াতাড়ি ফোন করে আসুন।
টেলিফোন বুথের সামনে গাড়ি রেখে পকেট হাতড়াল লিলি। ইসসি, একটাও নেই।
এই যে, নিন, পকেট থেকে কয়েন বের করে দিল রবিন।
কয়েন ফেলে ডায়াল করার পরে প্রায় ত্রিশ সেকেণ্ড অপেক্ষা করতে হলো লিলিকে। তারপর রিসিভার তুলল কেউ ওপাশে। হ্যালো, আমি লিলি অ্যালজেডো। কিংসলে ম্যাকম্বারের…হা হা, আমিই। শুনুন, একটা খবর আছে। গুহামানবের কঙ্কাল বিল চুরি করেছে। হ্যাঁ, সেন্টারে কাজ করে যে সে-ই। তাকে ধরতে এখন সেন্টারডেলে যাচ্ছি। ওঅ্যাডলি রোডে, সাইনস সার্ভিস কোম্পানিতে আছে। আমরা যাই, আপনারা আসুন।
রিসিভার নামিয়ে রেখে গাড়িতে এসে উঠল লিলি। আমাদেরকে যেতে মানা করছিল। লাইন কেটে দিয়েছি।
সেন্টারডেলের দিকে গাড়ি ছুটল।
শহর থেকে বেরোতেই গ্যাস পেডালে জোরে চেপে বসল লিলির পা। এক লাফে গাড়ির গতি বেড়ে গেল অনেক। তীব্র গতিতে ছুটল। শাই শাই করে পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে গাছপালা। ফ্লোরবোর্ডে পা চেপে ধরেছে ছেলেরা। কোন মোড়টোড় এলে চাপ আরও বাড়ায়। শরীর সোজা রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। তারপরেও গতি বাড়িয়েই চলেছে লিলি। শান্তশিষ্ট ভীতু মেয়েটা অকস্মাৎ খেপে গিয়েছে।
সবাই নীরব।
পথের পাশের সাইনবোর্ড জানিয়ে দিল, সেন্টারডেলে প্রবেশ করেছে গাড়ি। ব্রেক চেপে ধরল লিলি। কর্কশ আর্তনাদ তুলল টায়ার। গাড়ির গতি স্বাভাবিক গতিবেগে নামিয়ে আনল সে, নইলে পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হবে। এখন কোন বাধা আসুক, এটা চায় না।
দুটো সুপারমার্কেটের পাশ কাটিয়ে এসে ডানে মোড় নিল লিলি। পথের দুই ধারে ছোট ছোট দোকানপাট, তার পরে বাড়িঘর। মাঝে মাঝে গজিয়ে উঠেছে বিরাট বিরাট বিল্ডিঙ।
এটাই ওঅ্যাডলি রোড, জানাল লিলি। সাইনস সার্ভিস খুঁজে বের করতে সময় লাগল না। পার্কিং লটে বিলির পুরানো গাড়িটা নেই।
আসেনি নাকি? চিন্তিত কণ্ঠে বলল লিলি।
এক কাজ করুন, নিচের ঠোঁটে বারবার চিমটি কাটছে কিশোর।
শেরিফের অফিসে চলুন। হয়তো এসে ধরে নিয়ে গেছে ওকে।
সামনে এগিয়ে মোড় নিতেই দেখা গেল দুটো গাড়ি। সাইনস সার্ভিসের সীমানার মধ্যে, একটা গুদামের সামনে। শেরিফের গাড়ির পাশেই বিলের পুরানো গাড়িটা। বিল দাঁড়িয়ে আছে শেরিফের গাড়ির জানালার ধারে, হাতে স্প্রে-বটল। স্টীয়ারিং হুইলে মাথা রেখে পড়ে আছে একজন লোক, বোধহয় বেহুঁশ।
ইঞ্জিনের শব্দে মুখ ফিরিয়ে চেয়েই প্রায় দৌড়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠল বিল। স্টার্ট দিল। বিকৃত করে ফেলেছে মুখচোখ। গো গোঁ করে উঠেই বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। আবার চাবি ঘোরাল সে। স্টার্ট নিতে চাইছে না ইঞ্জিন, থেমে থেমে যাচ্ছে। অবশেষে স্টার্ট নিল। নড়ে উঠল গাড়ি।