চুরিটা যখন হয়, মুসা মনে করিয়ে দিল, তখন তিনি আমার পাশে বেহুশ হয়ে ছিলেন। আমার পরে ঘুম ভেঙেছে তাঁর। কাকে সন্দেহ করব? পুরো শহরই তো তখন পার্কে ঘুমিয়েছিল।
সবাই যে ছিল অনুষ্ঠানে, শিওর হচ্ছি কি করে? প্রশ্ন রাখল কিশোর। এত লোকের মধ্য থেকে কোন একজন সহজেই সরে পড়তে পারে।
চুপ, সাবধান করল রবিন। লিলি আসছে।
ফিরে দেখল কিশোর, মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে মেয়েটা। তাড়াতাড়ি জিনিসপত্রগুলোকে আড়াল করে বসল সে, ছাঁচটা যাতে লিলির চোখে না পড়ে। ও এলে হেসে বলল, এই যে, আপনিও এসেছেন।…আমরা চুরির ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
মাথা ঝাঁকাল লিলি। এখানে অনাহূত কিনা বোঝার চেষ্টা করল। চোখে সেই চিরন্তন অস্বস্তি। বসল তিন গোয়েন্দার দিকে মুখ করে। আমি সেন্টারে যাচ্ছি। ভাবলাম, তোমরাও যদি আসো…দেখতে চাও…
গেলে তো ভালই হয়, কিশোর বলল। কিন্তু…
ইচ্ছে না থাকলে এসো না, বাধা দিয়ে বলল লিলি। ভাবলাম, হয়তো বসে বসে বিরক্ত হচ্ছ, কিছু করার নেই… সামান্য উসখুস করে বলল, আসলে…দশ হাজার ডলার। অনেক টাকা। আঙ্কেল ম্যাকম্বার কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেছেন, কিভাবে জোগাড় করা যায়..
এত ভাবনার কিছু নেই তার, রবিন বলল। জ্যান্ত মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে তো আর জিম্মি করেনি।
না, তা করেনি। তবে ভীষণ খেপে গেছে আঙ্কেল। আমার ভয় করছে। তার অনেক টাকার ক্ষতি! সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেছে।
কিন্তু আপনার তো কোন দোষ নেই, বলল কিশোর।
দোষটা টাকার। অনেক টাকা আসত কঙ্কালটা দেখাতে পারলে। হার্ডঅয়্যারের দোকান থেকে তার একআনাও আসে না।
দোকানে যান নাকি?
যাই, যখন সেন্টারে কাজ থাকে না। বেচাকেনায় সাহায্য করি। তবে বাধ্য হয়ে যেতে হয়, ভাল লাগে না একটুও। ভাল লাগে সেন্টারে কাজ করতে। সেখানে কেউ গালমন্দ করে না। ডাক্তার হ্যারিসন মাঝে মাঝে চেঁচায়, হাসি ফুটল লিলির ঠোঁটে, তবে তাতে মনে করার কিছু নেই। ডাক্তারের স্বভাবই ওরকম। এমনিতে খুব ভাল মানুষ। আমাকে প্রায়ই বলে আমার কলেজে ভর্তি হওয়া উচিত, স্যান ডিয়েগোতে, অথবা অন্য কোথাও।
ঠিকই তো। হন না কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সেখানে যেতে গাড়ি লাগে। কোথায় পাব? জেলডা আন্টিকে একদিন বলেছিলাম, সোজা মানা করে দিয়েছে। মেয়েমানুষের বেশি পড়ে নাকি লাভ নেই, অযথা টাকা নষ্ট। তাছাড়া, আমার মায়ের পরিণতির কথাও নাকি আমার মনে রাখা উচিত।
মানে? মুসার প্রশ্ন।
মানে, কলেজে গেলেই নাকি নাক উঁচু স্বভাবের হয়ে যায় মেয়েরা। বেশি লেখাপড়া শিখে আমার মার-ও নাকি এমন হয়েছিল। এই শহরে আর মন টেকেনি। চলে গিয়েছিল বড় শহরে। আমার বাবাকে বিয়ে করেছিল। আর সেজন্যেই নাকি কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে ওরা।
গরু নাকি মহিলা! ফস করে বলে ফেলল মুসা।
আচ্ছা, তোমরাই বলল, চোখ ছলছল করছে লিলির, এটা কোন। কথা হলো? এ শহরে থাকলেই যে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যেত না, তার কোন গ্যারান্টি আছে? আর বলে কিনা, কলেজে গেলে উন্নাসিক হয়। আমি তো দেখেছি আমার মাকে, কত ভাল ছিল। সুন্দরী ছিল। আমার বাবাও ভাল ছিল। খুব সুন্দর শানাই বাজাত। শানাই খুব ভাল লাগে আমার। এখানে তো টিভি আর রেডিও ছাড়া কিছুই নেই। ভাল মিউজিক শোনার উপায় নেই।
থেমে দম নিল লিলি। তারপর আবার বলল, আমি এখান থেকে পালাতে চাই। টাকা জমাচ্ছি। সেন্টারে চাকরি করে যা পাই, তা থেকে। একশো ডলার জমিয়েছি। হলিউডে যে বাড়িটা আছে, সেটার ভাড়া তো আঙ্কেলই নিয়ে যায়, আমার থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ।
কত ভাড়া আসে, জিজ্ঞেস করেছেন কখনও? কিশোর বলল। সব টাকা লাগে আপনার খাওয়ায়? আপনি এখান থেকে চলে গেলে তো বাড়িভাঁড়ার কানাকড়িও পাবে না আপনার আঙ্কেল।
অবাক মনে হলো লিলিকে। কিন্তু আমি তো সেটা করতে পারব না। ভীষণ রেগে যাবে ওরা। আমাকে আর জায়গা দেবে না।
কি হবে তাতে? মুসা বলল। বাড়িভাঁড়ার টাকা দিয়েই তো আপনি চলতে পারবেন।
বলছি বটে পালাব, কিন্তু কোথায়, সেটাও ভাবি। যাওয়ার কোন জায়গা নেই আমার।
কেন, হলিউডে চলে যাবেন, পরামর্শ দিল রবিন। আপনার নিজের বাড়িতে।
তা কি করে হয়? ওটাতে লোক থাকে। তারা যাবে কোথায়? উঠে দাঁড়াল লিলি। ওখানে যেতে পারব না। আগে টাকা জমাই, তারপর দেখি কোথায় যাওয়া যায়।…তা তোমরা আসবে নাকি? যাবে। সেন্টারে?
আপনি যান, বলল কিশোর। গোলাঘরে যেতে হবে আমাদের। কয়েকটা জিনিস নিয়ে, তারপর আসছি।
লিলিকে চলে যেতে দেখল ছেলেরা।
পালানোর সাহস আছে ওর? মুসা বলল।
কি জানি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখানে থাকতেও চায় না, আবার অচেনা জায়গায় যেতেও ভয়।
ছাঁচ তোলার কাজটা শেষ করতে বসল সে।
তৈরি হয়ে গেল ডান পায়ের চমৎকার একটা প্রতিকৃতি।
দারুণ হয়েছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
হুম্ম্, দেখতে দেখতে আপনমনে মাথা দোলাল কিশোর। গুহামানবের পায়ে গণ্ডগোল ছিল।…দেখো, এই যে বুড়ো আঙুল। তারপর অনেক ফাঁক। এর পরে বাকি তিনটে আঙুল। মাঝের দ্বিতীয় আঙুলটা গেল কই? বুড়ো আঙুল আর বাকি তিনটের চাপে পড়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। ছাপ পড়েনি মাটিতে।
গুহামানবের ছাপ! অবাক হয়েছে রবিন।
ঠিক মানাচ্ছে না, না? জুতো ঠিকমত পায়ে না লাগলে এবং সেই জুতো অনেক দিন পরলেই কেবল আঙুলের এরকম গোলমাল হয়।