যখন বোঝা গেল, মাননীয় আর কেউ আসার নেই, ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল মেয়র। গম্ভীর ভঙ্গিতে টোকা দিল মাইক্রোফোনে, হাত তুলে ইশারা করল জনতাকে নীরব হওয়ার জন্যে।
লিলিকে দেখতে পেল কিশোর। মেয়েটার চোখে উৎকণ্ঠা, অধিকাংশ সময়ই যেমন থাকে।।
মাননীয় জনতা! শোনা গেল মেয়রের খড়খড়ে কণ্ঠ।
সম্বোধনের কি ছিরি!–ভাবল কিশোর।
মাননীয় জনতা! আবার বলল মেয়র। দয়া করে থামুন আপনারা, চুপ করুন। আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। প্রথমেই অনুরোধ করব, পাদ্রীর দিকে ফিরে একবার মাথা ঝোকাল মেয়র, মিস্টার ডেভিড ব্যালার্ডকে। আমাদের নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্যে যেন দোয়া করেন তিনি। তারপর ব্যাণ্ড বাজাবে সেন্টারডেল হাইস্কুলের ছেলেরা, তোমরা। অনুষ্ঠান শেষে মার্চ করে এগোবে, পেছনে দল বেঁধে যাব আমরা। মিউজিয়ম ওপেন করবে আমাদের মিস লোটি হাম্বারসন। থেমে জনতার ওপর চোখ বোলাল মেয়র। লোটি, তুমি কোথায়?
এই যে, এখানে! ভিড়ের মধ্য থেকে বলে উঠল একটা পুরুষকণ্ঠ। লোটি, যাও।
সরে জায়গা করে দিল লোকে। এগিয়ে এসে মঞ্চে উঠল পাতলা একটা মেয়ে, এত রোগা, মনে হয় ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। মাথায় সোনালি চুল। সে মঞ্চে উঠলে চেঁচিয়ে স্বাগত জানাল জনতা।
হঠাৎ চালু হয়ে গেল পার্কের অটোমেটিক স্পিঙ্কলার সিসটেম, বৃষ্টির মত জনতার ওপর ঝরে পড়তে লাগল পানি।
শুরু হলো চেঁচামেচি, হই-হট্টগোল। ঠেলাঠেলি, হুড়াহুড়ি।
কিশোরের মুখে এসে লাগল পানির ছিটা, মাথা ভিজল, কাপড় ভিজল। মুসার দিকে ফিরল। তাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু ভাজ হয়ে পড়ে যেতে শুরু করল মুসা।
কি ঘটে পুরোটা দেখার সময় পেল না কিশোর, তার দেহও টলে উঠল। বোঁ করে উঠল মাথার ভেতর। মনে হলো শূন্যে ভেসে চলেছে। সে, অনন্ত শূন্য, অসীম অন্ধকার।
শীত শীত লাগল। নড়েচড়ে উঠল কিশোর। ভেজা মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে সে। নাকে সুড়সুড়ে অনুভূতি। চোখ মেলে দেখল, একটা ঘাসের ডগা ঢুকেছে নাকে। থেমে গেছে স্পিঙ্কলার, পানি ছিটানো বন্ধ।
উহহ! গুঙিয়ে উঠল একটা পরিচিত কণ্ঠ।
ফিরে চেয়ে দেখল কিশোর, চোখ মেলছে রবিন। মুসা পড়ে আছে, মাথা ডাক্তার হ্যারিসনের কোমরে ঠেকে আছে।
বিড়বিড় গোঙানী, ফোঁসফোঁস, চিৎকার, নানারকম বিচিত্র শব্দ। একে একে হুশ ফিরছে জনতার।
ঢং ঢং করে বেজে উঠল গির্জার ঘণ্টা, সময় জানাচ্ছে।
চট করে ঘড়ি দেখল কিশোর। আরি! চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে! এগারোটা বাজে! কোন অদ্ভুত কারণে পুরো চল্লিশটি মিনিট বেহুশ হয়ে ছিল পার্কের লোক।
স্পৃিঙ্কলার সিসটেম! বিড়বিড় করল কিশোর। গোলমালটা ওটাতেই। কোন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল পানিতে, বেহুশ করার জন্যে।
পার্কের কিনারে চেঁচিয়ে কাঁদছে কয়েকটা বাচ্চা। বেলুনওয়ালার হাতে একটা বেলুনও নেই। গুচ্ছসহ উড়ে গেছে, আকাশের অনেক ওপরে বিন্দু হয়ে গেছে এখন ওগুলো।
মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথার ভেতরের ঘোলাটে ভাবটা দূর করার চেষ্টা করল কিশোর। টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়াল। রবিনকে উঠতে সাহায্য করল।
এই সময় ছুটে আসতে দেখা গেল জিপসি ফ্রেনিকে। যেন দিন দুপুরে ভূতে ধরেছে!
মিস্টার ম্যাকম্বার! চেঁচিয়ে উঠল সে। মিস্টার ম্যাকম্বার। সর্বনাশ হয়ে গেছে! গুহামানব!…নেই! চলে গেছে!…নিয়ে গেছে!
নয়
একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলল সীমাহীন ব্যস্ততা।
শেরিফের লোকেরা ছবি তুলছে, সূত্র খুঁজছে, পাউডার ছিটিয়ে আঙুলের ছাপ নিচ্ছে। মিস্টার আর মিসেস ম্যাকম্বারের বক্তব্য রেকর্ড করছে টেলিভিশনের লোকেরা। কথা বলবে কি? রাগে, ক্ষোভে পাগল হয়ে গেছে ম্যাকম্বার। মাথার চুল ছিঁড়ছে, হাত-পা ছুড়ছে থেকে থেকেই।
ডাক্তার হ্যারিসনের সাক্ষাৎকার নিল রিপোর্টাররা। ম্যাকম্বারের মত এতটা না হলেও তিনিও অস্থির।
মেয়রের সাক্ষাৎকার নিল। এমনকি জিপসি ফ্রেনিকেও ঘেঁকে ধরল টেলিভিশন আর খবরের কাগজের রিপোর্টাররা।
কি জানি এল! জানাল জিপসি। পাহারা দিচ্ছিলাম, মিস্টার ম্যাকম্বারের কথামত। পেছনে আওয়াজ শুনে ফিরে চাইলাম…আরিব্বাবা, দেখি কি, সাংঘাতিক এক জীব! একচোখা! এত বড় চোখ!…আর, হাতির মত দাঁত। মানুষ না, বুঝেছেন, মানুষ হতেই পারে না। তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম, মাটিতে পড়ে আছি। মিউজিয়ামের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখি, মড়াটা নেই! গায়েব!
বেশি টেনে ফেলেছে, ভিড়ের ভেতর থেকে বলল একজন।
কিন্তু মদ স্পর্শও করেনি ফ্রেনি। আর গুহামানবের কঙ্কাল গায়েব, এটাও সত্যি।
সাক্ষাৎকার নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল রিপোর্টাররা।
দু-জন লোককে পাহারায় রেখে শেরিফও চলে গেল।
ধীরে ধীরে কমে এল জনতার ভিড়। যাকে দেখতে এসেছিল, সে-ই নেই, থেকে আর কি করবে?
ডেপুটি শেরিফের সঙ্গে কথা বলছে ম্যাকম্বার।
কাছাকাছিই ছিল তিন গোয়েন্দা, ভিড় কমলে এগোল মিউজিয়ামের দিকে।
সরি, বয়েজ, ছেলেদের দেখে বলল ডেপুটি শেরিফ। ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
ডাবলডোরের ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, চাবি ছিল লোকটার কাছে, না? যে কঙ্কাল চুরি করেছে?
বিস্ময় ফুটল ডেপুটির চোখে। চট করে তাকাল একবার খোলা। দরজার দিকে।
দরজায় কোন দাগটাগ নেই তো, তাই বলছি, বুঝিয়ে বলল কিশোর। তারমানে, তালা কিংবা কজা ভেঙে ঢোকেনি চোর। তাহলে দাগ থাকতই।