এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, ভাবল কিশোর। হেঁটে গেছে। কেউ। পায়ের চাপে ঘাস বসে গেছে, শিশির ঝরে গেছে ওখান থেকে। ফলে কালো দেখাচ্ছে।
নামতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে জিপসি ফ্ৰেনি। বগলে শটগান। মাঠের দিকে ফিরে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে।
ভ্যানে গিয়ে ঢুকল ফ্রেনি। বেরিয়ে এল একটা কম্বল নিয়ে। ভাল করে গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বসল চেয়ারে।
ফ্রেনির বিশ্বাস, সে গুহামানব দেখেছে, আনমনে বলল কিশোর।
বাইরে তাকাল মুসা। জ্যোৎস্নায় আলোকিত তৃণভূমির দিকে চেয়ে অস্বস্তি জাগল মনে। ওকে দোষ দেয়া যায় না। বেশি ভয় পেলে জেগে থেকেও দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ।
সাত
পরদিন শনিবার।
আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের, মাচা থেকে নেমে বেরিয়ে এল গোলাঘরের বাইরে। উজ্জ্বল রোদে এখন আর রাতের মত কালো দেখাচ্ছে না বন, রহস্যময় লাগছে না। তৃণভূমির ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। মাটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু একটা পায়ের ছাপও চোখে পড়ল না। কালো দাগগুলোও মুছে গেছে নতুন করে শিশির জমায়।
তিরিশ মিটারমত এগিয়ে দেখল এক জায়গায় ঘাস বেশ পাতলা। কালো মাটি দেখা যায়। হাঁটু গেড়ে বসে ভালমত দেখে কেঁপে উঠল উত্তেজনায়।
মুসা এসে যখন তার পাশে দাঁড়াল, তখনও একইভাবে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
কী? জিজ্ঞেস করল মুসা। কিছু পেলে?
পায়ের ছাপ। এখান দিয়ে হেঁটে গেছে কেউ, খালি পায়ে। বেশিক্ষণ হয়নি।
ঝুঁকে মুসাও দেখল ছাপ। সোজা হয়ে তাকাল বনের দিকে। চেহারা ফ্যাকাসে।
খালি পায়ে!…তারমানে জিপসি সত্যি দেখেছিল…
জবাব দিল না কিশোর। উঠে হাঁটতে শুরু করল বনের দিকে।
কিছুই না বুঝে তার পিছু নিল মুসা।
মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে কিশোর। ধীরে ধীরে আবার ঘন হয়ে এসেছে ঘাস, আর একটা ছাপও চোখে পড়ল না তার। বনের কিনারে চলে এসেছে। গাছের নিচ দিয়ে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। সেখানে ছাপ নেই। ঘন হয়ে বিছিয়ে রয়েছে পাইনের কাটা।
এখানে দেখা যাবে না, বলল কিশোর। আরও এগোলে…
এক মিনিট, বাধা দিয়ে বলল মুসা। এখনি যাবে? হয়তো ঝোঁপের মধ্যে এখনও লুকিয়ে রয়েছে…আমি বলি কি চলো আগে কিছু। খেয়ে আসি? বেলা হলে, ভিড় বেড়ে গেলে হয়তো পাওয়াই যাবে না কিছু। শেষে না খেয়ে মরব।
মুসা, এটা খুব জরুরী! বলল কিশোর।
কার জন্যে? চলো, আগে পেট ঠাণ্ডা করি। বনের ভেতর। সারাদিনই খোঁজা যাবে, সময় তো আর চলে যাচ্ছে না।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফিরতে হলো গোয়েন্দাপ্রধানকে।
গোলাঘরের কাছে পৌঁছুল ওরা। ম্যাকম্বার বেরোল। মর্নিং, বয়েজ। দারুণ সকাল, তাই না? মনে হচ্ছে, মিউজিয়ামে আজ দিনটা কাটবে ভাল। ভ্যানের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, অ্যাই, ফ্রেনি।
দরজায় দেখা দিল জিপসি। হাতে খাবারের প্লেট।
আর গুহামানব দেখেছ, রাতে? হেসে জিজ্ঞেস করল ম্যাকম্বার।
না। একটাই যথেষ্ট, ভেতরে ঢুকে গেল ফ্রেনি।
রেগে উঠল ম্যাকম্বার। অ্যাই, আবার ঢুকলে যে? এখনও খাওয়াই শেষ করোনি, কাজ করবে কখন?
ওদের কথা শোনার জন্যে আর দাঁড়াল না তিন গোয়েন্দা, চলল শহরের দিকে।
কাফের সামনে ভিড় হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।
অনেক কষ্টে গুতোগুতি করে ভেতরে ঢুকে তিনটে চেয়ার দখল করল ছেলেরা। খাবারের অর্ডার দিল। লোকের কোলাহল ছাপিয়ে কানে আসছে ব্যাণ্ডবাদকদের বাজনা, মহড়া দিচ্ছে। মেইন রোডে গাড়ির সারি। কয়েকটা টেলিভিশন স্টেশনের ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে পার্কের একধারে।
খাবার এল। চামচ দিয়ে সবে মুখে তুলেছে ছেলেরা, এই সময় ঢুকলেন ডাক্তার রুডলফ। সঙ্গে ডাক্তার রেডম্যান, ইমিউনোলজিস্ট। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিশোরের ওপর চোখ পড়তেই হাসলেন রুলফ।
ওঁদের এখানে বসতে বললে কেমন হয়? বন্ধুদের পরামর্শ চাইল কিশোর।
ভাল, মুসা বলল। জিজ্ঞেস করো আগে, বসবেন কিনা।
উঠে গিয়ে আমন্ত্রণ জানাল কিশোর। সানন্দে রাজি হলেন দুই ডাক্তার। কোন টেবিল খালি নেই, জায়গা পেয়ে খুশিই হলেন।
থ্যাংক ইউ, বসতে বসতে বললেন ডাক্তার রুডলফ।
পাগল খানা হয়ে গেছে শহরটা। কতদিন এরকম থাকবে কে জানে। আমার মনে হয় সারাটা গরমই এভাবে যাবে। শীত পড়লে, তারপর গিয়ে কমতে শুরু করবে লোক। খানিকটা মাখন নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে বললেন, এমনিতে সেন্টারেই নাস্তা সারি আমরা। কিন্তু আজকাল হ্যারিসনের যা মেজাজ-মরজি। তার সঙ্গে বসে খেয়ে আর আরাম নেই। ওর দুঃখটাও বুঝি। হাতের কাছে রয়েছে গবেষণার এমন লোভনীয় জিনিস, অথচ হাত লাগাতে পারছে না…
হ্যাঁচচো করে উঠলেন রেডম্যান। নাকচোখ মুছে ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসলেন, সর্দির জ্বালায় আর বাঁচি না। রুডলফের দিকে ফিরে বললেন, যা-ই বলল, হ্যারিসন বাড়াবাড়িই করছে।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে বেচারার, নরম গলায় বললেন রুডলফ। প্রায় আস্ত একটা কঙ্কাল, অথচ ছুঁতে দেয়া হচ্ছে না ওকে, কল্পনা। করো। ওর জায়গায় আমি হলে আমারও একই অবস্থা হত।
ডাক্তার হ্যারিসন কি করতে চাইছেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। কার্বন ফরটিন টেস্ট?
কার্বন ফরটিন দিয়ে বোধহয় কাজ হবে না এটাতে। বুঝিয়ে বললেন রুডলফ, কার্বন ফরটিন রেডিওঅ্যাকটিভ এলিমেন্ট, প্রাণীর হাড়ে থাকে। জীব বা উদ্ভিদ মারা যাওয়ার সাতান্নশত বছর পরে হাড়ে এই এলিমেন্ট কমে অর্ধেক হয়ে যায়। আরও সাতান্নশো বছর পরে তার অর্ধেক। এভাবে কমতে কমতে চল্লিশ হাজার বছর পরে হাড়ে কার্বন আর থাকেই না। তখন পরীক্ষা করেও আর কিছু বোঝা যায় না।