ভ্যানের কাছে যাকে দেখলাম? কিশোর বলল।
হ্যাঁ। ওর নাম ফ্রেনটিস, সংক্ষেপে ফ্রেনি।
বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগাল ম্যাকম্বার। আসলে জিপসি নয় ও
গাড়িতে বাস করে তো, জিপসিদের মত যাযাবর, তাই লোকে ওর নাম রেখেছে জিপসি ফ্রেনি।
নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল ম্যাকম্বার।
ভ্যানের দরজা খুলে উঁকি দিল ফ্রেনি। আমাকে দারোয়ান রেখেছে বেতন দিয়ে, বেশ, পাহারা দেব। কিন্তু ভাল করছে না। মানুষটা এসব পছন্দ করবে না। আমার হাড় নিয়ে এসব করলে আমি কি সহ্য করতাম?
কিন্তু ও জানছে কিভাবে? বলল মুসা। ও তো মরা, তাই না? ওকে নিয়ে কে কি করল না করল তাতে ওর কিছুই যায়-আসে না।
তাই নাকি? রহস্যময় শোনাল জিপসির কণ্ঠ।
ছয়
ডিনারও সারতে হলো হ্যামবার্গার দিয়েই। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রীম কিনে খেল তিনজনে। তারপর এসে উঠল গোলাঘরের মাচায়। খোলা জানালা দিয়ে দেখল সূর্যের অস্ত যাওয়া আর চাঁদের উদয়। বাতাস ঠাণ্ডা। তৃণভূমির ওপর হালকা ধোয়ার মত উড়ছে কুয়াশা।
স্লীপিং ব্যাগ টেনে নিল ছেলেরা। ঘুমিয়ে পড়ল।
অন্ধকারে দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কে যেন ঢুকেছে গোলাঘরে। ভীত জানোয়ারের মত গোঙাচ্ছে। উঠে বসে কান পাতল সে।
মুহূর্তের জন্যে থামল গোঙানি, তারপর আবার শুরু হলো।
নড়েচড়ে মুসাও উঠে বসল। ফিসফিসিয়ে বলল, কে?
জবাব না দিয়ে মাচার ফোকরের কাছে গিয়ে নিচে উঁকি দিল কিশোর। অন্ধকার।
এই, ছেলেরা, শুনছ? খসখসে ভাঙা কণ্ঠস্বর। আছ ওখানে?
জিপসি ফ্ৰেনি। এগোতে গিয়ে কিসের সঙ্গে পা বেধে ধুড়স করে পড়ল।
ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
টর্চের জন্যে হাত বাড়াল মুসা। স্লীপিং ব্যাগের পাশেই তো ছিল। গেল কই? হাতড়ে হাতড়ে বের করে নিয়ে এসে মই বেয়ে নামল কয়েক ধাপ। নিচের দিকে মুখ করে জ্বালল।
একটা খালি বাক্সে পা লেগে পড়ে গেছে ফ্ৰেনি। উঠে তাকাল আলোর দিকে। তোমরাই তো? কণ্ঠে আতঙ্ক। জবাব দিচ্ছ না কেন? তোমরা তো?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর।
মই বেয়ে নেমে এল তিনজনে।
ম্যাকম্বারের পিকআপে হেলান দিয়ে কাঁপছে জিপসি।
কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মড়া…মড়াটা! ভয়ে ভয়ে বলল ফেনি। বলেছিলাম না, পছন্দ করবে না!
হয়েছেটা কি? মুসা জানতে চাইল।
ও উঠে চলে গেছে। কাল যখন গিয়ে দেখবে কঙ্কলটা নেই, আক্কেল হবে ম্যাকম্বারের। দোষ দেবে আমার। বলবে আমি সরিয়েছি। আসলে তো হেঁটে চলে গেছে। নিজের চোখে দেখলাম।
গোলাঘরের দরজা খোলা। পাহাড়ের ঢালে নতুন বাড়িটা, মানে ম্যাকম্বারের মিউজিয়ামটার দিকে তাকাল ছেলেরা। চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে-দরজা লাগানো। তালা আছে কিনা বোঝা যায় না।
স্বপ্ন দেখেননি তো? মোলায়েম গলায় বলল রবিন।
না, মাথা নাড়ল লোকটা। গাড়ির মধ্যে শুয়ে ছিলাম। দরজা খোলার শব্দ শুনে উঁকি দিয়ে দেখি একটা গুহামানব। গায়ে পশুর ছাল জড়ানো। চোখ দুটোও দেখেছি। ভয়ঙ্কর। সোজা আমার দিকেই চেয়ে ছিল। জ্বলছিল কয়লার মত। লম্বা লম্বা চুল। গাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল মাঠের দিকে।
চোখ বুজল জিপসি, যেন চোখ বুজলেই স্মৃতি থেকে দূর হয়ে যাবে ভয়ানক দৃশ্যটা।
চলো তো দেখি, কিশোর বলল সঙ্গীদের।
কাছাকাছি রইল ওরা। যেন ভয়, যে কোন মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে উঠে। এসে সামনে দাঁড়াবে প্রাগৈতিহাসিক মানুষটা।
দেখা গেল, মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ।
কথাবার্তার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বেরোল ম্যাকম্বার। কি হয়েছে? এই, তোমরা এখানে কি করছ?
দেখছি, জবাব দিল কিশোর। আপনার দারোয়ান মাঠের ওদিকে কাকে নাকি যেতে দেখেছে।
মিসেস জেলা ম্যাকম্বারও উঁকি দিল পেছনে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এগিয়ে এল ম্যাকম্বার। কি হয়েছে? ফ্রেনিকে জিজ্ঞেস করল। হ্যারিসন এসেছিল নাকি?
গুহামানব, বলল জিপসি, চলে গেছে।
কি পাগলের মত বকছ? ধমক লাগাল ম্যাকম্বার। জেলডা, চেঁচিয়ে বলল, চাবি আনো তো।
তালা খুলে মিউজিয়ামে ঢুকল ম্যাকম্বার। আলো জ্বালল। এগিয়ে গেল গুহামুখের দিকে। পেছনে চলল ছেলেরা।
কই, ঠিকই তো আছে। আগের মতই তাকিয়ে আছে শূন্য কোটর। বিকট নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন একটিমাত্র চোয়াল। বুকের পাঁজর, হাত-পায়ের হাড়, সব ঠিক আছে।
জিপসির দিকে ফিরল ম্যাকম্বার। কি দেখেছ? এই তো, কঙ্কাল তো এখানেই।
হেঁটে গেছে! বিড়বিড় করল ফ্রেনি। আমি দেখেছি। গায়ে পশুর ছাল। বড় বড় চুল। হেঁটে চলে গেল মাঠের ওপর দিয়ে।
তোমার মাথা। যত্তোসব।
আলো নিভিয়ে সবাইকে নিয়ে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকম্বার। যাও, ভালমত পাহারা দাও, ধমক দিয়ে বলল ফ্রেনিকে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার জন্যে বেতন দিই না আমি তোমাকে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল আবার জেলডা আর ম্যাকম্বার।
আপনমনে কি বলতে বলতে ভ্যান থেকে একটা ফোল্ডিং চেয়ার বের করল জিপসি। শটগান হাতে পাহারায় বসল।
গোলাঘরে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।
নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছে, মুসা মন্তব্য করল।
বোকা মনে হয় লোকটাকে, বলল রবিন।
আমার মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর।
তাহলে সত্যি দেখেছে কিছু?
হতে পারে। হয়তো কেউ বেরিয়েছিল মিউজিয়াম থেকে।
কিভাবে? মুসার প্রশ্ন। দরজায় তালা ছিল।
চাবি জোগাড় করে নিয়েছে, স্লীপিং ব্যাগের ওপরে বসে খোেলা জানালা দিয়ে চন্দ্রালোকিত মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। রাতের আকাশের পটভূমিকায় ওপাশের বনকে ঘন কালো দেখাচ্ছে। চাঁদের আলোয় সাদা লাগছে ঘাসের ওপরে জমা শিশিরকে, যেন সাদা চাদর। তাতে কালো কালো ছোপ এক সারিতে এগিয়ে গেছে বনের দিকে।