রোভার লক্ষী ছেলে, হাসি মুখে প্রশংসা করল টিনহা। ডুবুরীর ফ্লিপার পরাই আছে তার পায়ে, ডাইডিং গগলসটা ফিতেয় ঝুলছে গলা থেকে, ওটা পরে নিল চোখে। পুলে নামল।
বেশ ভাল সাঁতারু মুসা নিজে, অনেক ভাল ভাল সাঁতারুকে দেখেছে, কিন্তু টিনহার মত কাউকে আর দেখেনি। সাঁতার কাটার জন্যেই যেন জন্ম হয়েছে তার, ডাঙা নয়, পানির জীব যেন সে, এমনি স্বচ্ছন্দ সাবলীল ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে। হাত-পা প্রায় নড়ছেই না, বাতাসে ডানা মেলে যে ভাবে ভেসে উড়ে চলে সোয়ালো পাখি টিনহার সাঁতার কাটার ভঙ্গি অনেকটা সেরকম।
চোখের পলকে চলে এল পুলের মাঝখানে ছোট তিমিটার কাছে। এমন ভাবভঙ্গি যেন অনেক পুরানো বন্ধুত্ব। নাক দিয়ে আস্তে করে টিনহার গায়ে এতো মারল তিমিটা। ওর গোল মাথাটা ডলে দিল টিনহা, ঠোঁটে টোকা দিয়ে আদর করল। এক সঙ্গে ডাইভ দিয়ে নেমে চলে গেল পুলের তলায়, হুঁশ করে ভেসে উঠল আবার। পাশাপাশি সাঁতার কাটল কিছুক্ষণ, তারপর তিমির পিঠে সওয়ার হলো টিনহা।
কোথায় রয়েছে ভুলেই গেছে মুসা দেখতে দেখতে। নিজের অজান্তেই একটা গাছের গোড়ায় ঘাসের ওপর বসে পড়েছে, থুতনিতে হাত ঠেকানো। এরকম দৃশ্য সিনেমায়ও দেখা যায় না, পুরোপুরি মগ্ন হয়ে গেছে সে।
নতুন খেলা শুরু করল টিনহা। তিমিটাকে নিয়ে চলে এল পুলের এক প্রান্তে, মূসা যেদিকে বসে আছে সেদিকে তিমির মাথায় আস্তে করে চাপড় দিয়ে হঠাৎ পানিতে ডিগবাজি খেয়ে শরীর ঘুরিয়ে শাঁ করে চলে গেল দূরে। তিমিটা অনুসরণ করল তাকে।
আবার তিমির মাথায় চাপড় দিল টিনহা, মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। আবার সরে গেল তিমির কাছ থেকে। এবার আর পিছু নিল না তিমি, যেখানে আছে সেখানেই রইল।
পুলের অন্য প্রান্তে গিয়ে কংক্রিটে বাঁধানো পাড়ের কিনারে উঠে পানিতে পা ঝুলিয়ে বসল টিনহা। অপেক্ষা করে আছে তিমি।
রোভার! রোভার! ডাকল টিনহা।
পানি থেকে মাথা তুলল তিমি। চোখ সতর্ক হয়ে উঠেছে, দেখতে পাচ্ছে মুসা। দুটতে শুরু করল তিমি। পানির মধ্যে দিয়ে শাঁ করে উড়ে গিয়ে পৌঁছল যেন টিনহার পায়ের কাছে।
লক্ষ্মী ছেলে, লক্ষ্মী রোভার, তিমির ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করল টিনহা। কাত হয়ে হাত বাড়িয়ে কনটেইনার থেকে একটা মাছ এনে গুজে দিল রোভারের খোলা মুখে।
লক্ষ্মী ছেলে, লক্ষ্মী রোভার, আবার তিমিটাকে আদর করল সে। তারপর পাশে ফেলে রাখা একটা বিযেন তুলে নিল।
জিনিসটা কি চিনতে পারছে না মুসা। পূলের নিচে আলো আছে, তাতে পুরোপুরি আলোকিত হয়েছে পানি। কিন্তু পুলের ওপরে চারধারে অন্ধকার।
নাম ধরে ডাকল তিমিটাকে টিনহা।
মাথা তুলেই রেখেছে, রোভার, আস্তে আস্তে উঁচু করতে শুরু করল শরীর। নেজের ওপর খাড়া হয়ে উঠল আশ্চর্য কায়দায় পানিতে ভর রেখে। ওটাকে জড়িয়ে ধরল টিনহা। না না, জড়িয়ে তো ধরেনি, দুহাত তিমির মাথার পেছনে নিয়ে গিয়ে কি যেন করছে।
ভাল করে দেখার জন্যে মাথা আরেকটু উঁচু করল মুসা। চিনে ফেলল জিনিসটা। ক্যানভাসের তৈরি একটা লাগাম পরাচ্ছে টিনহা। ঘাড় তো নেই তিমির চোখের পেছনে যেখানে ঘাড় থাকার কথা সেখানে লাগিয়ে দিচ্ছে কেট। শক্ত করে বকলেস আটকে দিল। ঠিক লাগাম বলা যায় না ওটাকে, কুকুরের গলায় যে রকম কলার আটকানো হয় তেমন ধরনের একটা কিছু কলারও ঠিক বলা চলে না।
হঠাৎ মাথা নুইয়ে ফেলল মূসা। উপড় হয়ে শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।
গেট খোলার শব্দ। বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে পায়ের আওয়াজ। এত কাছে এসে গেল, মুসার ভয় হলো তাকে না দেখে ফেলে।
পুলের দিকে চলে গেল পদশব্দ, থামল।
হাই টিনহা, পুরুষের গলা।
শুড ইভিনিং, মিস্টার উলফ।
মাথা তুলে দেখার সাহস হলো না মুসার, শুধু থুতনিটা ঘাসের ছোঁয়া মুক্ত করে তাকাল পলের দিকে।
টিনহার পাশে দাঁড়িয়েছে লোকটা। বেঁটেই বলা চলে, মেয়েটার চেয়ে ইঞ্চি। ছয়েক খাটো। অন্ধকারে রয়েছে মুখ। চেহারা বোঝার উপায় নেই। তবে একটা জিনিস দিনের আলোর মত স্পষ্ট। টাক। পুরো মাথা জুড়ে টাক, আবছা
অন্ধাকরেও চকচক করছে। হাতের চামড়া আর শরীরের বাধন দেখে অনুমান করল মুসা, লোকটার বয়েস তিরিশের বেশি হবে না, বয়েসের ভারে চুল উঠে গেছে তা নয়।
কেমন চলছে? জিজ্ঞেস করল লোকটা। কখন রেডি হবে? টেনে টেনে কথা বলে।
শুনুন, মিস্টার উলফ, লোকটার দিকে তাকাল টিনহা, শীতল কণ্ঠস্বর। রেগে যাচ্ছে বোঝাই যায়। শুধু বাবার জন্যে আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছি। আমাকে আমার মত কাজ করতে দিন। সময় হলে বলব। বেশি বাড়াবাড়ি যদি করেন, রোভার সাগরে ফিরে যাবে। আরেকটা তিমি এক আরেকজন ট্রেনার খুঁজে বের করতে হবে তখন আপনাকে। এক মুহুর্ত থেমে বলল, বুঝেছেন?
বুঝেছি, মিস শ্যাটআ-নোগা।
৪
ঠিক শুনেছ তুমি? মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। শিওর, ওই একই গলা?
র্যঞ্চ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে ডবল মার্চ করে পাহাড়ী পথ ধরে একটা পেট্রল স্টেশনে নেমে আসতে বিশ মিনিট লেগেছে মুসার, হেডকোয়ার্টারে ফোন করেছে। আরও বিশ মিনিটের মাথায় বোরি আর রবিনকে নিয়ে গাড়িসহ পৌঁছেছে কিশোর, তিনজনেই ফিরে যাচ্ছে এখন রকি বীচে।
যা যা ঘটেছে সব বলেছে মুসা। মাথার নিচে হাত রেখে ট্রাকের মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে সে।