কিশোরের নেমে যাওয়ার আওয়াজ শুনল মুসা। তারপর অনেকক্ষণ আর কোন শব্দ নেই, শুধু পার্কিং লটে মাঝে মাঝে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়া ছাড়া।
বেশ আরামেই আছে মুসা, সারাটা দিন পরিশ্রমও কম করেনি। ঘুম এসে গেল তার। হঠাৎ একটা শব্দে তন্দ্রা টুটে গেল। ক্যানভাসের ওপর পানি ছিটকে পড়েছে, কয়েকটা ফোটা চুইয়ে এসে তার মুখ ভিজিয়ে দিল। ঠোঁটেও লাগল পানি। কি ভেবে জিভ দিয়ে চাটল। নোনা পানি।
ট্রাকটা স্টার্ট নিল। গতি বাড়া পর্যন্ত অশেক্ষা করল মুসা, তারপর সাবধানে মুখের ওপর থেকে ক্যানভাস সরিয়ে উঁকি দিল। তার মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে রয়েছে বড় একটা প্ল্যাসটিক কনটেইনার। চার পায়ের ওপর রয়েছে জিনিসটা। মূসা রয়েছে তলায়। পানি ছলাৎছল করছে ভেতরে। জীবন্ত কিছু ঘষা মারছে কনটেইনারের গায়ে।
মাছ, অনুমান করল মুসা, মাছ জিয়াননা রয়েছে ভেতরে। আবার মুখের ওপরে ক্যানভাস টেনে দিল সে।
ছুটে চলেছে ট্রাক, ঝাকুনি প্রায় নেই। তারমানে সমতুল মসৃণ রাস্তা দিয়ে চলেছে। বোধহয় কোস্ট হাইওয়ে ধরেই। কয়েক মিনিট পর গতি কমল ট্রাকের। ওপর দিকে উঠতে শুরু করল পাহাড়ী পথ বেয়ে। কোথায় এল? সান্তা মনিকা? কোন দিকে কবার মোড় নিচ্ছে গাড়ি খেয়াল রাখার চেষ্টা করল সে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। গোলমাল হয়ে গেল। আবার সমতলে নেমে এল গাড়ি।
অন্ধকার নামার পর আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল গাড়ি। নেশ ঘোরানো পথ। সান্তা মনিকায় পাহাড়ী অঞ্চলেরই কোন জায়গা হবে, অনুমান করল মুসা।
অবশেষে থামল পিকআপ। টেইল গেট নামানোর শব্দ শোনা গেল। তারপর খালি পায়ের শব্দ। দম বন্ধ করে রইল মুসা।
পানির জোর ছলাৎছল, নিশ্চয় কনটেইনারটা তোলা হচ্ছে। চলে গেল পায়ের শব্দ।
মিনিট তিনেক অপেক্ষা করল মুসা, তারপর ওপর থেকে ক্যানভাস সরাল।
বেশ বড়সড় বিলাসবহুল একটা র্যঞ্চ হাউসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। পিকআপ। সদর দরজার সামনে একটা ল্যাম্প ঝুলছে। কংক্রিটের সিড়ি উঠে গেছে দরজা পর্যন্ত। সিড়ির গোড়ায় একটা মেইলবক্স। নামটা পড়তে পারছে মুসা : উলফ।
আরও এক মিনিট অপেক্ষা করল মুসা, তারপর খুব সাবধানে নামল ট্রাক থেকে। ঘুরে চলে এল গাড়ির সামনের দিকে, বনেটের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাড়িটার ওপর নজর রাখার ইচ্ছে।
কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এই এলাকায় ওরকম বাড়ি থাকতে পারে ভাবেনি সে। তবে অবাক হলো অন্য একটা কারণে। দরজার কাছে ওই একটি মাত্র আলো ছাড়া পুরো বাড়িটা অন্ধকার। কোন জানালায় আলো নেই। টিনহা ওই বাড়ির ভেতরে গিয়েছে কিংবা আছে বলে মনে হয় না ভাবসাব দেখে।
এখানে সারারাত এভাবে ঘাপটি মেরে থাকার কোন মানে নেই, ডাবল মুসা। দুটো কাজ করতে পারে সে এখন। গলির মাথায় গিয়ে রাস্তার নাম-নম্বর জেনে উলফের ঠিকানা জানিয়ে কোথাও থেকে ফোন করতে পারে কিশোরের কাছে। কিংবা খোজ করে দেখতে পারে, টিনহা কোথায় গেছে, কি অবস্থায় আছে, কি করছে প্ল্যাসটিক কনটেইনারের জ্যান্ত মাছ নিয়ে।
দুটোর মধ্যে প্রথমটাই মনঃপূত হলো মুসার। গলির মাথায় যাওয়ার জন্যে সবে পা বাড়িয়েছে, এই সময় মেয়েলী কণ্ঠে কথা শোনা গেল, কাকে জানি নাম ধরে ডাকছেঃ রোভার! রোভার!
ডাকের জবাব শোনা গেল না।
মুসা শিওর, ঘরের ভেতর থেকে কথা বলেনি মেয়েটা, বাইরে কোথাও রয়েছে। হয়তো পেছনের আঙিনায়।
বাড়িতে ঢোকার পথ খুঁজতে লাগল মুসা। চোখে পড়ল, বাঁ দিকে কংক্রিটের একটা সরু পথ ধীরে ধীরে উঠে গেছে গ্যারেজে। গ্যারেজের পাশে একটা কাঠের ঘোট গেট, তার ওপরে তারাজ্বলা কালো আকাশের পটভূমিকায় কয়েকটা পাম গাছের মাথা।
নিঃশব্দে গেটের কাছে চলে এল মুসা। সাধারণ একটা খিল দিয়ে গেটের পান্না আটকানো রয়েছে। ভেতরে ঢুকে আবার লাগিয়ে দিল পান্না।
গ্যারেজের পেছনে সিমেন্ট বাঁধানো একটা পাকা পথ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝুঁকে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল পা পা করে।
আবার ডাক শোনা গেল : রোভার! রোভার!
খুব কাছেই রয়েছে মহিলা। মূসার মনে হলো, মাত্র কয়েক গজ দূরে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। সামনে আর বাঁয়ে এক চিলতে করে ঘাসে ঢাকা জমির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে পামের সারি, রাস্তা থেকেই দেখেছে ওগুলো। ডানের কিছু দেখতে পারছে না। বাগান বা যা-ই থাকুক ওখানে দেখা যাচ্ছে না এখনও গ্যারেজের দেয়ালের জন্যে। এক সেকেণ্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল সে, তারপর এক ছুটে ঘাসে ঢাকা জমি পেরিয়ে চলে এল পামের সারির কাছে। লম্বা দম নিয়ে ঘুরে তাকাল।
চোখে পড়ল বিশাল এক সুইমিং পুল, মূল বাড়িটার প্রায় সমান লম্বা। পানির নিচে আলো, ঝিকমিক করছে টলটলে পানি।
রোভার। লক্ষ্মী ছেলে রোভার, বলল টিনহা।
সুইমিং পুলের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সে, পরনে সেই টু-পীস সাঁতারের পোশাক, অফিসে যেটা পরে ছিল সকালে। তার পাশে কংক্রিটের চত্বরের ওপর রাখা আছে প্ল্যাসটিকের কনটেইনারটা।
ঝুঁকে কনটেইনার থেকে একট মাছ তুলে নিল টিনহা, জ্যান্ত মাছ, ছটফট করছে, লেজ ধরে ওটাকে ছুঁড়ে মারল। বৈদ্যুতিক আলোয় ক্ষণিকের জন্যে রূপালী একটা ধনুক সৃষ্টি করে পুলের ওপর উড়ে গেল মাছটা।
সঙ্গে সঙ্গে পানি থেকে মাথা তুলল একটা ধূসর জীব। উঠছে, উঠছে, উঠছে, পানি থেকে বেরিয়ে এল পুরো সাত ফুট শরীর। একটা মুহুর্ত শূন্যেই স্থির হয়ে ঝুলে রইল যেন। মুখ হাঁ করে রেখেছে। শুন্যে থেকেই মোচড় দিয়ে শরীর বাকিয়ে ধরে ফেলল উড়ন্ত মাছটা, তারপর নিখুত ভাবে ডিগবাজি খেয়ে আবার পানিতে পড়ল মাছ মুখে নিয়ে।