হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা।
তিরিশ ফুট লম্বা একটা মোবাইল হোম ট্রেলারের ভেতরে গঠিত হয়েছে হেডকোয়ার্টার। অনেক আগে ওটা কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা, বিক্রি হয়নি। নানা রকম লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে এখন পুরোপুরি চাপা পড়ে গেছে ট্রেলারটা। তার ভেতরে ঢোকার কয়েকটা গোপন পথ আছে, জানে শুধু তিন গোয়েন্দা। পথগুলো ওরাই বানিয়েছে।
অনেক যত্নে হেডকোয়ার্টার সাজিয়েছে ওরা। ভেতরে ছোটখাট একটা আধুনিক ল্যাবরেটরি বসিয়েছে, ফটোগ্রাফিক ডার্করুম করেছে, অফিস সাজিয়েছে– চেয়ার টেবিল ফাইলিং কেবিনেট সবই আছে। একটা টেলিফোনও আছে, বিল ওরাই দেয়। অবসর সময়ে ইয়ার্ডে কাজ করে, মুসা আর কিশোর, পারিশ্রমিক নেয়। স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে বই সাজানো-গোছানোর পার্ট টাইম চাকরি করে রবিন। তাছাড়া গোয়েন্দাগিরি করেও আজকাল বেশ ভাল আয় হচ্ছে।
টেলিফোন ডিরেক্টরিটা টেনে নিল কিশোর, ওশন ওয়ারন্ডের নাম্বার বের করে। ডায়াল করল।
ফোনের সঙ্গে স্পীকারের যোগাযোগ করা আছে, ওপাশের কথা তিনজনে একই সঙ্গে শোনার জন্যে এই বিশেষ ব্যবস্থা।
রিঙ হওয়ার শব্দ শোনা গেল, তারপর জবাব এল।
ওশন ওয়ারন্ডে ফোন করার জন্যে ধন্যবাদ কেমন যেন যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, সাজানো কথা। টোপাঙ্গা ক্যানিয়নের উত্তরে, প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ের ঠিক পাশেই মিলবে ওশন ওয়ারল্ড। গড়গড় করে আরও অনেক কথা বলে গেল লোকটাঃ টিকেটের দাম কত, দেখার কি কি জিনিস আছে, কোন দিন কটা থেকে কটা পর্যন্ত খোলা থাকে, ইত্যাদি। বলল, ওশন ওয়াল্ড রোজই ভোলা থাকে, সকাল দশটা থেকে বিকেল ছটা পর্যন্ত সোমবার ছাড়া… রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। এটাই জানতে চেয়েছিল।
হায় হায়রে, কপাল চাপড়াল মুসা, বদনসীব একেই বলে। হপ্তার যে দিনটায় বন্ধ সেদিনই ফোন করলাম আমরা।
আনমনে মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ভাবছে কি যেন, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়েছে।
তো এখন কি করব? জিজ্ঞেস করল রবিন। আগামীকাল আবার ফোন করব?
ফোন করে আর কি হবে? বলল কিশোের। যা জানার তো জেনেছিই। মাত্র কয়েক মাইল এখান থেকে। সাইকেলেই যাওয়া যাবে। কাল একবার নিজেরাই গিয়ে দেখে আসি না কেন?
পরদিন সকাল দশটায় ওশন ওয়ারন্ডের বাইরে সাইকেল-স্ট্যাণ্ডে সাইকেল রেখে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াল বিশাল অ্যাকোয়ারিয়ামের আশেপাশে, কৃত্রিম ল্যাগুনে সী-লায়নের খেলা দেখল, তীরে পেইনের হুটোপুটি দেখল, তারপর চলল অফিসবিল্ডিঙের দিকে। একটা দরজার ওপরে সাদা কালিতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে : অ্যাডমিনিসট্রেশন।
দরজায় টোকা দিল কিশোর।
মোলায়েম মেয়েলী গলায় সাড়া এল ভেতর থেকে, কাম ইন।
অফিসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।
ডেস্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক তরুণী পরনে টু-পীস সুইম স্যুট-সাঁতার কাটতে যাচ্ছিল বোধহয়। গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, গাঢ় বাদামী। ছোট করে ছাটা কালো চুল, কোমল, রেড ইণ্ডিয়ানদের মত। মুসার চেয়েও লম্বা, চওড়া কাঁধ, অস্বাভাবিক সরু কোমর, কেন যেন মাছের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়, ডাঙার চেয়ে পানিতেই তাকে মানাবে ভাল।
আমি চিনহা শ্যার্টানোগা, বলল তরুণী। কিছু বলবে?
একটা তিমির খবর নিতে এসেছি, বলল কিশোর। চরায় আটকা পড়েছিল… খুলে বলল সে।
নীরবে সব শুনল টিনহা। কিশোরে কথা শেষ হলে বলল, কবের ঘটনা? গতকাল?
মাখা ঝোঁকাল কিশোর।
গতকাল আমি ছিলাম না। আলমারি খুলে একটা ডাইভিং মাস্ক বের করল টিনহা। সোমবারে দু-চারজন শুধু স্টাফ থাকে, আর সবার ছুটি! মাস্কের ফিতে খুলে নিয়ে আবার ছেলেদের দিকে ফিরল সে, কিন্তু গতকাল কোন তিমি আনা হলে, আমি আজ আসার সঙ্গে সঙ্গে জানানো হত আমাকে।
আনা হয়নি? হতাশ শোনাল রবিনের কণ্ঠ।
মাথা নাড়ল টিনহা। মাস্কটা দেখতে দেখতে বলল, না, আনলে জানানো হতই। সরি, কিছু করতে পারলাম না তোমাদের জন্যে।
না না, দুঃখ পাওয়ার কি আছে… তাড়াতাড়ি বলল মুসা।
আমি দুঃখিত, আবার বলল টিনহা। আমাকে এখন যেতে হচ্ছে। একটা শো আছে।
যদি তিমিটা সম্পর্কে কিছু জানতে পারেন, তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর, আমাদের জানালে খুব খুশি হব।
কার্ডটা নিয়ে টেবিলে রেখে দিল টিনহা, একবার চোখ বুলিয়েও দেখল না।
ঘুরে সারি দিয়ে দরজার দিকে এগোল ছেলেরা। দরজা খোলার জন্যে সবে হাত বাড়িয়েছে মুসা, পেছন থেকে ডেকে বলল টিনহা, তিমিটার জন্যে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে তোমাদের, না? সাধারণ একটা পাইলট কিংবা গ্রে…
হ্যাঁ, হচ্ছে, বাধা দিয়ে বলল রবিন। কারণ ওটাকে বাচাতে অনেক কষ্ট করেছি।
চিন্তা কোরো না, হাসল টিনহা। ভালই আছে ওটা। কেউ ওটাকে নিশ্চয় উদ্ধার করে নিয়ে গেছে, বলেই আরেক দিকে তাকাল সে।
স্ট্যাণ্ড থেকে সাইকেল নিয়ে ঠেলে এগোল কিশোর, চড়ল না। নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে, বুঝতে পারল অন্য দুজন, তারাও ঠেলে নিয়ে এগোল।
ওশন ওয়ার থেকে একটা সরু পথ গিয়ে মিশেছে বড় রাস্তার সঙ্গে। সেখানে এসে সরু রাস্তার পাশের দেয়ালে সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখল কিশোর। দেখাদেখি অন্যেরাও তাই করল। কিশোরের হাসি হাসি মুখ, কোন জটিল রহস্যের সন্ধান পেলে যেমন হয়, তেমনি।
রবিন বিষণ্ণ, মুসা হতাশ। তিমিটার খোঁজ মেলেনি।