উইণ্ডব্রেকার খুলতেই নোকটার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। হালকা-পাতলা দুর্বল একজন মানুষ, বেচারার দুরবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে রবিনের। রোভারের সাহায্যে পানির একেবারে কিনারে নিয়ে এল নোকটাকে। তারপর ঠ্যাং পরে টেনে এনে ফেল বালিতে।
চিত হয়ে পড়ে হাঁপাচ্ছে নোকটা। এত কাহিল, ওঠার ক্ষমতা নেই। হ্যাট খুলে পড়ে গেছে পানিতে। মাথার ওপর টেনে দেয়া মোজাট রয়েছে।
টেনে মোজা খুলে রবি।
বেরিয়ে পড়ল লম্বা, ধারাল নাক। সামান্য বসা গাল। ডান চোখের নিচে কুঁচকানো দাগ।
নীল বনেট।
১৬
ওই, চেঁচাল উলফ, ওই জানোয়ারটা। জানোয়ারকে বলল জান-ওয়ার।
চোখ থেকে বিনকিউলার সরিয়ে কিশোরকে বলল সে, ঠিকই আন্দাজ করেছ। ব্যাটা ওখানেই ফিরে গেছে। তাড়াতাড়ি ককপিটে এসে কিশোরকে সরিয়ে হুইল ধরল।
টিনহাও দেখেছে রোভারকে। রেলিঙে বুকে দাঁড়িয়েছে সে। ডাকল, রোভার। এই রোভার!
ডাক শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলল রোভার। ছুটে আসতে শুরু করল।
বাক্স কই? বকের মত মাথা বাড়িয়ে দেখছে উলফ। বাক্সটা কই?
তীরের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। বালিতে পড়ে আছে একটা লোক, তার পাশে দাঁড়ানো রবিন। এদিকেই চেয়ে রয়েছে সে। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাথা ঠেকিয়ে গোল করে দেখিয়ে ইঙ্গিত দিল ঃ সব ঠিক আছে! – তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার, মুসাকে ফিসফিস করে বলল কিশোর। উলফ কিছু বোঝার আগেই।
ঠিকই বলেছ, ওয়েট সুট খোলেনি মুসা। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরাতে শুরু করল।
জামা খুলে কিশোরও পানিতে নামল, সাঁতরে চলল তীরের দিকে।
আরে, নীল বনেট! হাত দিয়ে গায়ের পানি মুছতে মুছতে বলল কিশোর। ও কি করছিল এখানে? রবিন, কি ব্যাপার?
সংক্ষেপে সব জানান রবিন। সব শেষে বলল, মরেই গিয়েছিল আরেকটু . শরীরে কিছু নেই, একেবারে কাহিল।
কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরে তাকাল কিশোর। তীরের যতটা সম্ভব কাছে বোট নিয়ে এসেছে উলফ। নোঙ্গর ফেলেছে। রোদে চকচক করছে টাকা উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে লাফিয়ে নামল পানিতে।
বাক্সটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
লুকিয়ে ফেলেছি… উলফকে দেখে চুপ হয়ে গেল রবিন।
নীল বনেটের দিকে তাকালই না উলফ। ওকে এখানে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক নি। ছেলেদের কাছে এসে রবিনকে বলল বাক্সটা কোথায়?
জবাব দিল না রবিন।
এই ছেলে, তোমাকে বলছি, খেকিয়ে উঠল উলফ। বাক্সটা দাও।
কিসের বাক্স? আকাশ থেকে পড়ল যেন রবিন। কনুই দিয়ে আলতো গুঁতো দিল মূসার শরীরে। উলফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ইঙ্গিত। তার ইচ্ছে, মূসা লোকটাকে আটকে রাখতে পারলে দৌড়ে গিয়ে বাক্স নিয়ে সাইকেলে করে পালিয়ে যাবে।
ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে ধমকে উঠল উলফ, খবরদার! কোন চালাকি নয়। কোমর পর্যন্ত ভেজা তার। খাটে ডেনিম জ্যাকেটে পানি লাগেনি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। আবার যখন বের করল, হাতে দেখা গেল ভোতা নাক ছোট একটা পিস্তল, কুৎসিত চেহারা।
রবিনের দিকে পিস্তল তাক করল উলফ। বাক্স। তিমিটা নিয়ে এসেছে। দাও, কেই-আটা, জলদি।
অসহায়ভাবে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।
কিশোর চেয়ে আছে পিস্তলের দিকে। আগ্নেয়াস্ত্রের ওপরে পড়াশোনা মোটামুটি করছে। উলফের হাতে ওটা কোন কোম্পানির চিনতে পারল না, তবে ব্যারেলের আকার দেখে অনুমান করল, নিশানা মোটেই ভাল হবে না অস্ত্রটার। দশ গজ দূর থেকেও ওটা দিয়ে লক্ষ্য ভেদ করা কঠিন হবে। কিন্তু উলফ ধরে রেখেছে রবিনের বুকের এক ফুট দূরে।
রবিন, কিশোর বলল, দিয়ে দাও বাটা।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। মুখ কালো, এত কষ্ট করে লাভ হলো না। পাথরের কাছে এসে দাঁড়াল। তার পেছনেই রয়েছে উলফ। বাক্সটা তুলল রবিন। নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল উলফ।
না-আ-আ-আ! তীক্ষ্ণ চিৎকার।
প্রথমে বুঝতে পারল না রবিন চিৎকারটা কোথা থেকে এসেছে। তারপর দেখল, এলোমেলো পায়ে দৌড়ে আসছে বনেট।
ঘুরে চেয়েছে উলফ। চিৎকারে সে-ও অবাক হয়েছে।
রবিনের মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে কিশোর, মাথা নেড়ে ইশারা করল। বক্সট ছুঁড়ে দিল রবিন। লুফে নিল কিশোর।
উলকে গাল দিতে দিতে আসছে বনেট, বেঈমান! হারামী! মিথ্যুক! চোর!
রবিন আর কিশোরের দিকে নজর দেয়ার আগেই উলফের ওপর এসে ঝাপিয়ে পড়ল বনেট। আঙুল বাঁকা করে খামচি মারতে গেল চকচকে টাকে, গলা চেপে ধরতে গেল। পিস্তল নামিয়ে ফেলেছে উলফ, কনুই দিয়ে পেটে তো মেরে বনেটকে গায়ের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করল, এপাশ-ওপাশ সরাচ্ছে মাথা।
ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে পড়ে গেল বনেট, কিন্তু উলফের জ্যাকেট ছাড়ল না, তাকে নিয়ে পড়ল।
বাক্সটা কিশোরের হাতে মুসা দাঁড়িয়ে আছে দশ গজ দূরে, পানির কিনারে। আরেকটু দূরে পানিতে রোভারের গায়ে গা ঠেকিয়ে দেখছে টিনহা।
মুসার কাছে বাক্সটা ছুঁড়ে দিল কিশোর।
ঝাড়া দিয়ে জ্যাকেট ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল উলফ। আবার কাহিল হয়ে গেছে বনেট, দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়াল সে-ও।
বাক্সটা ধরেছে মুসা। টিনহার দিকে তাকাল।
বুঝতে পারল টিনহা। তীরের দিকে সারাতে শুরু করল।
বাক্সটা দু-হাতে বুকে ঝাপটে ধরে টিনহার দিকে ছুটল মুসা। ছুটতে শুরু করেছে উলফ। চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও। দাঁড়াও, বলছি।
কে শোনে তার কথা? ফিরেও তাকাল না মুসা। বুঝতে পারছে, তার দিকেই চেয়ে আছে উলফের পিস্তল, কিন্তু তোয়াক্কা করল না।