পুরো এক মিনিট পানিতে গা ডুবিয়ে রইল তিমি, মুখ দিয়ে পানি টানল, তারপর সামান্য ভেসে উঠে ফোয়ারা ছিটাল মাথার ফুটো দিয়ে, তিন গোয়েন্দার গা ভিজিয়ে দিয়ে যেন ধন্যবাদ জানাল।
ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসল মুসা। ব্যাটা, আবার রসিকতা জানে…
যাক, মুসার কথায় কান না দিয়ে বলল রবিন, জোয়ার আসাতক বেঁচে থাকতে পারবে।
জোয়ার তো সময়মত ঠিকই আসবে, আমাদেরও সময়মত যাওয়া দরকার, বলল কিশোর। মনে নেই, আজ ইয়ার্ডে কাজ আছে? তাছাড়া নাস্তা…
যাহ, মুসা বলল, এক্কেবারে ভুলে গেছি! আপেলের বরফি আর মুরগীর রোস্ট খাওয়াবেন কথা দিয়েছেন মেরিচাচী! চলল, চলো। তিমিটার দিকে ফিরল, হেই মিয়া, তুমি পানি খাও, আমরা যাই, মুরগী ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
মুসার কথায় সায় জানাতেই যেন আরেকবার তাদের গায়ে পানি ছিটাল তিমি।
গর্তের কিনারে এসে দাঁড়াল রবিন। তিমিটার উদ্দেশ্যে বলল, থাক। কোন অসুবিধে হবে না। আবার আসব আমরা।
তাড়াহুড়ো করে জুতোমোজা পরে নিল তিনজনে। পাম্প, বেলচা আর হোসপাইপ গুছিয়ে নিয়ে এসে উঠল পাড়ের ওপর। মাটিতে শুইয়ে রাখা সাইকেলগুলো তুলে মাল বোঝাই করল। রওনা হতে যাবে, এই সময় একটা শব্দে ফিরে তাকাল কিশোর।
মাইল দুয়েক দূরে ছোট একটা জাহাজ-একটা কেবিন ক্রুজার, আউটবোর্ড মোটর-ধীরে ধীরে চলেছে। দুজন লোক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এত দূর থেকে চেহারা বোঝা গেল না।
হঠাৎ আলোর ঝিলিক দেখা গেল জাহাজ থেকে। পর পর তিনবার।
আয়নার সাহায্যে সিগন্যাল দিচ্ছে, বলল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর, আমার মনে হয় না। যেভাবে ঝলকাচ্ছে, কোন নিয়মিত প্যাটার্ন নেই। অন্য কোন জিনিস, বোধহয় বিনকিউলারের কাচে রোদ লেগে প্রতিফলিত হচ্ছে।
ব্যাপারটা অন্য দুজনের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না, কিন্তু কিশোর সাইকেলে চড়ল না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে জাহাজটার দিকে। নাক ঘুরে গেছে ওটার, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এদিকেই।
কি হলো, চলো, অধৈর্য হয়ে তাড়া দিল মুসা। সব কিছুতেই রহস্য খোঁজার স্বভাব ছাড়ো। রোজ শয়ে শয়ে লোক এদিক দিয়ে যায় আসে, তাছাড়া ইদানীং অনেকেই আমাদের মত শখের তিমি গবেষক হয়েছে। তিমির যাওয়া দেখার শখও আমাদের একলার না।
জানি, সন্তুষ্ট হতে পারছে না কিশোর, হ্যাণ্ডেল ধরে ঠেলে নিয়ে চলল সাইকেল বাধ্য হয়ে রবিন আর মুসাকেও ঠেলেই এগোতে হলো। কিন্তু বোটের লোকটা তিমি দেখছে না। ওর বিনকিউলারের চোখ তীরের দিকে, এদিকে। আমাদেরকেই দেখছে না তো?
দেখলে দেখছে। কোন অসুবিধে আছে তাতে? বলল মুসা।
জবাব দিল না কিশোর।
মেরিচাচী অপেক্ষা করছেন। হাসিখুশি মানুষ, সারাক্ষণ হাসি লেগেই আছে মুখে। হাসেন না শুধু ছেলেদেরকে কাজ করানোর সময়, আর ইয়ার্ডের দুই কর্মচারী-দুই ব্যাভারিয়ান ভাই বোরিস আর রোভারকে খাটানোর সময়। ও, আরও একটা সময় হাসেন না, যখন রাশেদচাচা একগাদা পুরানো বাতিল জঞ্জাল মাল নিয়ে আসেন, যেগুলো কোনভাবেই বিক্রি করা যাবে না, তখন।
মাল জোগাড়েই ব্যস্ত থাকেন রাশেদ পাশা, ইয়ার্ডের দেখাশোনা মেরিচাচীকেই করতে হয়। কোনটা সহজেই নেবে খদ্দের, কোনটা নেবে না, স্বামীর চেয়ে অনেক ভাল বোঝেন তিনি।
তিন ছেলেকে দেখে হাঁ হাঁ করে উঠলেন মেরিচাচী, এই, তোরা কি রে? সেই কখন থেকে খাবার নিয়ে বসে আছি, সব জুড়িয়ে গেল, সাইকেল থেকে কিশোরকে পাম্প নামাতে দেখে অবাক হলেন তিনি। আরে এই কিশোর, পাম্প নিয়েছিলি কেন? রবিন আর মুসা নিয়ে যাওয়ার সময় দেখেননি তিনি, বোরিসের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা।
সাগর সেঁচতে গিয়েছিলাম, চাচী, হাসল কিশোর।
তোর মাথা-টাতা খারাপ হয়ে যায়নি তো, এই কিশোর।
মুসার এখন পেট জ্বলছে, মজা করার সময় নেই, তাড়াতাড়ি সব বুঝিয়ে বলল মেরিচাচীকে।
ভরপেট নাস্তা খেয়ে কাজে লেগে গেল তিন গোয়েন্দা। দুপুর পর্যন্ত গাধার মত খাইল। দুপুরের খাওয়া রেডি করে ডাকলেন মেরিচাচী। হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে কসল ওরা।
খাওয়ার পর আবার রওনা হলো সাগর পারে, তিমিটাকে দেখতে।
২
হয়তো গড়িয়ে-টড়িয়ে নেমে চলে গেছে সাগরে, বলল বটে মুসা, কিন্তু কথাটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
অসম্ভব, রবিন বলল, যা শুকনো বালি…নাহ, ইমপসিবল।
কিশোর চুপ। গর্তের আশেপাশে ঘুরছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি দেখছে বালিতে।
একটা ট্রাক এসেছিল, সঙ্গীদের দিকে ফিরল কিশোর, ফোর হুইল ড্রাইভ। ওই ওদিকে কোথাও দিয়ে নেমেছিল, তারপর সৈকত ধরে এগিয়ে এসেছে। এই যে এখানটায়, গর্তের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ, কয়েক ইঞ্চি দেবে গিয়েছিল চাকা, পরে সামনের চাকার নিচে বোর্ড ফেলে তুলতে হয়েছে।
কোনটা কিসের দাগ বুঝিয়ে দিল কিশোর।
ট্রাক! বিড়বিড় করল মুসা।
কেন, কোন সন্দেহ আছে?
তারমানে তুলে নিয়ে গেছে তিমিটাকে?
তাই করেছে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। কিন্তু কারা? চরায় আটকা পড়ায় তিমি কারা নিতে পারে? কাদের দায়িত্ব?
জবাবের অপেক্ষা করল সে। এগিয়ে গিয়ে গর্ত থেকে তারপুলিনটা ধরে টান দিল। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল রবিন আর মুসা।
ওশন ওয়াল্ড, আধ ঘণ্টা পরে প্রশ্নের জবাব দিল কিশোর নিজেই। সকালে আমরা চলে আসার পর কেউ গিয়েছিল সৈকতে, তিমিটাকে দেখে ওশন ওয়ারন্ডে খবর পাঠিয়েছিল। ওরাই এসে তুলে নিয়ে গেছে।