বোটের সামনের দিকটা খুঁজে পেয়েছে ক্যামেরার চোখ।
ওই যে, কিশোরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুসা, বলে উঠল উত্তেজিত কণ্ঠে।
বড় হচ্ছে বোটের গলুই, ভরে দিচ্ছে আলোর চক্র। হঠাৎ সরে গেল, গাড়ির পাশ দিয়ে যেভাবে সরে যায় থাম কিংবা গাছ, সেভাবে। ডেক দেখা গেল, এক ঝলকের জন্যে হুইলটা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, মেঘে ঢাকা পড়েছে সাদা চক্র। সরে গেল মেঘ, আগের চেয়ে উজ্জ্বল হলো আলো, স্পষ্ট হলো ছবি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা চেয়ার, একটা পোর্টহোল।
সোজা কেবিনে ঢুকে পড়েছে রোভার।
কয়েক সেকেণ্ড পর্দায় এত তাড়াতাড়ি নানারকম আকৃতি ফুটল, ঝাকুনি খেলো ছবি, কিছুই বোঝা গেল না। টানটান হয়ে গেছে উলকের স্নায়ু, উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে পেশী।
ছবির উন্মাদ নাচ ঝিমিয়ে এল এক সময়, স্থির হলো, স্পষ্ট হলো আবার। চেনা যাচ্ছে এখন। ধাতব বাক্সটা দেখা যাচ্ছে।
ওটাই, হইলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে উলফ, মনিটরের পর্দা থেকে ছোঁ মেরে তুলে আনবে যেন।
বড় হচ্ছে বাক্সটা…আরও…আরও বড়, ভরে দিল আলোর চক্র, বাক্সের খুব। কাছে চলে গেছে ক্যামেরার চোখ।
ভীষণভাবে দুলে উঠল বাক্সটা আচমকা, পরক্ষণেই হারিয়ে গেল। আর কিছু নেই পর্দায়, শুধু শূন্য গোল সাদা আলো।
কুটি করল কিশোর। ক্যামেরায় কোন গণ্ডগোল হলো? তারপর বুঝল, না ক্যামেরা ঠিকই আছে, নইলে আলো আসত না, আসলে সাদা দেয়ালের ওপর স্থির হয়ে রয়েছে যন্ত্রটার চোখ। নিশ্চয় বাংকের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে রোভার।
কিছুক্ষণ প্রায় অনড় হয়ে রইল সাদা আলো, তারপর আবার দুলে উঠল। নানারকম অস্পষ্ট ছবি ঝড় তুলল আবার পর্দায়। কিশোরের মনে হলো, আবছাভাবে দেখতে পেয়েছে বোটের তামার রেলিঙ।
আবার আলোর সামনে ফুটল পরিচিত ধোয়াটে মেঘ। উঠে আসছে রোভার।
আস্ত একটা গর্দভ জানোয়ার! গলা কাপছে উলকের, হুইল এত জোরে চেপে ধরেছে সাদা হয়ে গেছে আঙুল। বাক্সটা তোলার চেষ্টাই করল না। রাগে ঝটকা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল তীরের দিকে।
উলফের কথায় কান দিল না কিশোর। পলকের জন্যে পর্দায় একটা ব্যাপার দেখেছে, যা মিস করেছে লোকটা। ক্যামেরার চোখের সামনে অনেক বড় হয়ে ফুটেছিল একটা মানুষের হাত, নিশ্চয় টিনহার, সরে গেছে সঙ্গে সঙ্গেই। তার কয়েক মুহূর্ত পরই নিবে গেল গোল আলো। ক্যামেরা অফ করে দিয়েছে টিনহা।
এই, হুইল ধরো, মুসার বাহু ধরে টান দিল উলফ। সোজা রাখবে বোট, নড়ে না যেন।
ছুটে ডেকে বেরোল উলফ, রেলিঙে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। তার পিছু নিল কিশোর, কিন্তু গঁড়াল না, পাশ কাটিয়ে চলে এল বোটের পেছনে, লকারের কাছে। সাগরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বিশ গজ দূরে ভেসে উঠ টিনহার মাথা। কাধে দড়ির বাণ্ডিলটা নেই, এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।
টিনহার পাশে ভেসে উঠেছে রোভার। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করল কিশোর, ক্যামেরা আর সার্চলাইট নেই, তার জায়গায় বাধা রয়েছে সবুজ ধাতব বাক্সটা।
লকার খুলে সার বকিয়ে রাখা প্লাসটিকের ব্যাগটা বের করল কিশোর। এক টানে ব্যাগের মুখ ছিড়ে ভেতর থেকে বের করল একটা ওয়াকিটকি। টেনে অ্যান্টেনা পুরো তুলে দিয়ে সুইচ অন করল।
যন্ত্রটা মুখের কাছে এনে জরুরী কণ্ঠে বলল, রবিন, প্লে করো! রবিন, প্লে করো!
ফিরে তাকাল উলফের দিকে। রেলিঙে ঝুঁকে রয়েছে লোকটা, আর সামান্য কলেই উল্টে পড়ে যাবে পানিতে, এদিকে নজরই নেই।
নিয়ে এসো! চেঁচিয়ে বলল উল। বাক্সটা নিয়ে এসো। এই মেয়ে, শুনছ?
রবিন, প্লে করো! আবার বলল কিশোর। রোভারের গান প্লে করো! রবিন, প্লে করো! রোভারের গান প্লে করো!
১৪
শুনেছি, কিশোর। ওভার অ্যাণ্ড আউট!
ওয়াকি টকির সুইচ অফ করে পাশের পাথরের ওপর রেখে দিল রবিন।
এখান থেকে উলফের বোট দেখা যাচ্ছে না। কতদূরে আছে, তা-ও বোঝার উপায় নেই। তবে তিমির শ্রবণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ, এটা জানা আছে, জেনেছে বই। পড়ে। সাধারণ দৃষ্টিতে তিমির কান চোখে পড়ে না, কাছে গিয়ে ভাল করে দেখলে দেখা যাবে, চোখের ঠিক পেছনে সুচের ফোঁড়ের মত অনেকগুলো ছিদ্র।
রেডিওর স্পীকারের সামনে যেমন তারের জাল বা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া। হর, তিমির কানও তেমনিভাবে ছিদ্রওয়ালা চামড়ায় ঢাকা। মানুষের কানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী কান। অসাধারণ আরেকটা ক্ষমতা আছে ওই কনেক-সোনার সিসটেম, শব্দের প্রতিধ্বনি শুনেই বলে দিতে পারে, কি জিনিসে আঘাত খেয়েছে শব্দ, জিনিসটা কত বড় এবং কত দূরে আছে, একশো গজ দূর থেকেও সেটা নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে তিমি। পানির নিচে একে অন্যের ডাক কয়েক মাইল দূর থেকেও শুনতে পায় ওরা।
তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার আর জুতো খুলে নিল রবিন। বাতাসনিরোধক বাক্সে ভরা টেপরেকর্ডারটা তুলে নিয়ে এসে নামল সাগরে। পানিতে ডুবিয়ে টিপে দিল প্লে করার বোতাম। ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল ক্যাসেটের চাকা, ফিতে পেঁচাচ্ছে। ফুল ভলিয়ুমে সাগরের পানিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে রোভারের রেকর্ড করা কণ্ঠ।
মানুষের কান সে শব্দ শুনতে পাবে না, কিন্তু রোভারের কানে হয়তো পেছবে, অনেক দূর থেকেও।
বোটের পেছনে আগের জায়গায়ই রয়েছে কিশোর। তাড়াতাড়ি আবার লকারে লুকিয়ে ফেলল ওয়াকি-টকিটা।