পানির ওপরে ভেসে উঠল মুসার মাথা। পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে একটানে তার মাস্ক খুলে নিল কেউ। হাঁ করে দম নিল সে, ফুসফুস পূর্ণ করে টানল বিশুদ্ধ বাতাস।
ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে সরে গেল লাল অন্ধকার। নিচে তাকিয়ে আবছা একটা ঝিলিমিলি দেখতে পেল। ছবিটা স্পষ্ট হতে সময় নিল।
ক্যানভাসের কলারটা চিনতে পারল সে। একটা সার্চলাইট। একটা ক্যামেরা।
রোভারের পিঠে শুয়ে আছে মুসা।
পাশে ভাসছে টিনহা। সেই খুলে নিয়েছে মুসার মাস্ক। চুপ, কথা নয়। লম্বা লম্বা দম নাও। এক মিনিটেই ঠিক হয়ে যাবে।
তা-ই করল মুসা। রোভারের পিঠে গাল রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল। সহজ হয়ে এল শ্বাস-প্রশ্বাস। হাপাচ্ছে না আর। সেই ভয়ঙ্কর লাল অন্ধকারের ছায়াও নেই, সরে গেছে পুরোপুরি। কথা বলার ক্ষমতা ফিরে এল।
কিন্তু কোন প্রশ্ন করার আগে, কি হয়েছিল টিনহাকে জিজ্ঞেস করার আগে, আপনা-আপনিই একটা কথা বেরিয়ে এল অন্তর থেকে, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, রোভার।
তুমিও একদুিন ওর প্রাণ বাঁচিয়েছিলে, মনে নেই? রোভারের মাথায় হাত রাখল টিনহা। ও কিছু ভোলে না…
পাশে চলে এসেছে বোট। হুইল ধরেছে কিশোর। রেলিঙের ওপর ঝুঁকে রয়েছে উলফ।
দেখেছি, চেঁচিয়ে বলল সে, উত্তেজনায় জ্বলছে যেন টাক। মনিটরে দেখলাম, এক ঝলক। কিন্তু দেখেছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। শ্যাটানোগার বোট। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, ধরে রাখো, নড়বে না। ঠিক আমাদের নিচেই রয়েছে। রোভার ওপরে ওঠার সময় আলো পড়ল, তখনই দেখলাম বোটটা। তাহলে…
এখন পারব না, কড়া গলায় বাধা দিল টিনহা। মুসাকে আগে ডেকের ওপর তুলি, দেখি কি হয়েছে, কি গোলমাল।
কিন্তু…রেলিঙে থাবা মারল উলফ।
পরে, কণ্ঠস্বর বদলাল না টিনহা। যান, গিয়ে হুইল ধরুন, কিশোরকে পাঠিয়ে দিন, সাহায্য দরকার।
দ্বিধা করল উলফ। কিন্তু জানে, এখন সব কিছু টিনহার হাতে। এ-মুহূর্তে ওকে চটানো উচিত হবে না। ওর সাহায্য ছাড়া বোট থেকে মাগুলো উদ্ধার করতে পারবে না। গোমড়া মুখে মাথা ঝাঁকাল সে, গিয়ে কিশোরের হাত মুক্ত করল।
মুসাকেবোটে উঠতে সাহায্য করল কিশোর আর টিনহা। এখনও দুর্বল লাগছে, ডেকেই বসে পড়ল মুসা। এক মগ গরম কফি এনে দিল টিনহা। ইতিমধ্যে বেল্ট খুলে এয়ার ট্যাংক আর অন্যান্য যন্ত্রপাতির বোঝা মুসার পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়েছে কিশোর।
ও-কে, জিজ্ঞেস করল টিনহা, এবার বলো, কি হয়েছিল। গোলমানটা কি ছিল? পানির চাপ না, এত গভীরে নামোনি। কি?
দম নিতে পারছিলাম না, মগে চুমুক দিল মুসা, কফি খুব ভাল বানানো হয়েছে। টিউব দিয়ে বাতাস আসছিল না। ভাবলাম জট লেগেছে। কিন্তু লাগেনি।
তার কি কি অসুবিধে হয়েছিল, জানাল মুসা। কি ভাবে চোখের সামনে রঙ বদলে গিয়েছিল, লাল হতে হতে কালো হয়ে গিয়েছিল, সে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল গলা।
কারবন-ডাই-অকসাইড, বলল টিনহা। কারবন-ডাই-অকসাইড টানছিলে।
এয়ার ট্যাংকটা টেনে নিয়ে ভালভ খুলল সে, হিসহিসিয়ে চাপ চাপ বাতাস বেরোল না।
এজন্যেই শ্বাস নিতে পারোনি, বাতাসই নেই ট্যাংকে।
কিন্তু নামার আগে চেক করেছি, বলল মুসা।
প্রেসার গজটা পরীক্ষা করল কিশোর। কাটা এখনও ফুল নির্দেশ করছে। দেখাল টিনহাকে। কেউ গজ জ্যাম করে দিয়েছে। তারপর ট্যাংক থেকে বাতাস বের করে দিয়েছে।
একমত হলো টিনহা। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।
যন্ত্রপাতিগুলো কোত্থেকে এনেছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওশন ওয়ারল্ড। আমি নিজে এনে রেখেছি গতরাতে। সব কিছু ঠিকঠাক ছিল তখন। উলফের কাছে গিয়ে দাঁড়াল টিনহা। মুসার ট্যাংকে গোলমাল কে করেছে? আমি জানতে চাই
আমি কি জানি? রেগে গেল উল। যন্ত্রপাতি আমি নষ্ট করতে যাব কেন? আমি কি গাধা, জানি না, গণ্ডগোল করে দিলে বোটের মাল তুলতে অসুবিধে হবে? এই যে দেরিটা হচ্ছে, ক্ষতি কি আমার হচ্ছে না? আমি শুধু চাই… কি চায়, উত্তেজিতভাবে দ্রুত বলে গেল সে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অনেক শব্দ ভেঙে ফেলল, হাস্যকর করে তুলল কথাগুলো।
উলফের কথা বিশ্বাস করল কিশোর, সত্যি কথাই বলছে। মুলার ট্যাংক নষ্ট করে দিয়ে তাকে মেরে ফেললে উলফের কোন লাভ হবে না। জিজ্ঞেস করল, গতরাতে এই বোট কেউ উঠেছিল? কিংবা আজ ভোরে?
না, মাথা নাড়ল উলফ। ঘাটে বাঁধা ছিল। গতরাতে আমি বোটে ঘুমিয়েছি। টিনহা যাওয়ার পর একবারও নামিনি।
কেউ দেখা করতে এসেছিল?
না। শুধু আমার বন্ধু নীল বনেট। আমার সঙ্গে বসে হুইসকি খেয়েছে, কিন্তু নীলকে আমি অবিশ্বাস করি না…
ওকে কতদিন থেকে চেনেন? বাধা দিয়ে বলল কিশোর। ও কে? ওর সম্পর্কে কি কি জানেন?
প্রশ্ন। বোকার মত খালি প্রশ্ন, বিরক্তিতে মুখ বাঁকাল উলক, টাকে খামচি মারল। এত কথা বলতে পারব না। যাও, গিয়ে বাক্সটা তোলো…
জবাব দিন, কঠিন শোনাল টিনহার গলা, কোমরে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়েছে। যা যা জিজ্ঞেস করে, সব কথার জবাব দেবেন। নইলে ওই বোটের ধারেকাছে যাব আমি।
ঠিক আছেহ্! হাত নাড়ল উলফ, রাগ দমন করে বলল, কি জানতে চাও? নীলের সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
মাথা নোয়াল কিশোর।
কয়েক বছর। ইউরোপে দেখা হয়েছিল। ওখানে দুজনে… দ্বিধা করল উলফ। কিছু ব্যবসা করেছি একসঙ্গে। তারপর আবার দেখা হয়েছে মেকসিকোতে।
কবে?
কয়েকবারই হয়েছে…