ও-কে, মুসা, হয়েছে, মুসার পিঠে এয়ার ট্যাংক বেঁধে দিয়ে বলল টিনহা।
মাস্ক পরে নিল মুসা, ব্রীদি হোস আর এয়ার-প্রেশার গজ চেক করে দিল টিনহা। বাতাসের ট্যাংক ফুল শো করছে গজের কাঁটা।
পারে ফ্লিপার, বিচিত্র একটা জম্ভর মত থপাস থপাস করে ডেক দিয়ে হেঁটে গেল মুসা টিনহার পেছনে। রেলিঙে উঠে বসল টিনহা, সাগরের দিকে পেছন করে, রেলিঙ ধরে আস্তে করে উল্টে গিয়ে আলগোছে ছেড়ে দিল হাত, ঝপাং করে পড়ল পানিতে।
মুসা পড়ল টিনহার পর পর।
কয়েক ফুট নেমে গিয়ে ডিগবাজি খেয়ে শরীর সোজা করল মুসা, মাথা নিচু করে ভেসে রইল। মনে করার চেষ্টা করল ওস্তাদ কি কি শিখিয়েছেন। কি করতে হবে এখন।
মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলবে, তাতে তোমার মাস্ক ধোয়াটে হবে না, পরিষ্কার দেখতে পাবে। এয়ার হোস চেক করা, হোসে গিটটিট লেগেছে কিনা, বাতাস রুদ্ধ হয়েছে কিনা শিওর হয়ে নাও। তোমার সুইম স্যুটের ভেতরটা নিশ্চয় ভেজা-ভেজা লাগছে, অপেক্ষা করো, সাগরের পানি আর তোমার দেহের তাপমাত্রা এক হয়ে নিক। এবার নামতে শুরু করে, মনে রাখবে, যত নিচে নামবে পানির তাপ ততই কমবে, চাপ বাড়বে। মাথা গুলিয়ে উঠছে টের পেলেই আর নামবে না, সঙ্গে সঙ্গে উঠতে শুরু করবে, তবে আস্তে আস্তে, তাড়াহুড়ো করবে না।
তিন ফুট পানির নিচে অলস ভঙ্গিতে কয়েক মিনিট সঁতরে বেড়াল মুসা, শরীরকে ঢিল হওয়ার সময় দিল, সইয়ে নিল এখানকার পানির সঙ্গে।
ডাইভিং খুব পছন্দ মুসার। দারুণ একটা অনুভূতি। মনে হচ্ছে, বাতাসে ভাসছে সে, পাখি যেভাবে ভাসে। আশ্চর্য এক স্বাধীনতাবোধ। দেখতে পাচ্ছে, কয়েক গজ দূরে তারই মত ভেসে রয়েছে টিনহা আর রোভার। হাত তুলে ইঙ্গিত করল মুসা, বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাথা লাগিয়ে গোল করে দেখাল, তারমানে ডাইভ দেয়ার জন্যে তৈরি। .
রোভারের পিঠ চাপড়াল টিনহা। নিচের দিকে মুখ করে ডাইভ দিল রোভার, তার আগে আগে পানি ছুঁড়ে নেমে যাচ্ছে শক্তিশালী সার্চলাইটের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। নামছে…নামছে…নামছে… ওকে অনুসরণ করতে কো পেতে হচ্ছে মুসার, এমনকি টিনহারও।
ককপিটে বসে দেখছে কিশোর, টেলিভিশন মনিটরের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ। হুইলে হাত রেখে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে রয়েছে উলফও।
দেখতে দেখতে মনে হলো কিশোরের, পানির তলার দৃশ্য নয়, মহাকাশের বিচিত্র দৃশ্য দেখছে। তীব্র সাদা গোল একটা আলোর চক্র যেন মহাকাশের কালো অন্ধকারে ফুটে উঠেছে, তার মাঝে ফুটছে নানা রকম রঙ, আকৃতি। একবার মনে হলো, মেঘলা আকাশ দেখছে, তারপর এলোমেলো হয়ে ঝাপসা হয়ে গেল মেঘ, সরে গেল, লাফ দিয়ে এসে যেন সে জায়গা দখল করল এক ঝাক রঙিন মাছ। সরে গেল ওগুলোও।
রোভার বোট থেকে পাশে বেশি সরলে আবছা হয়ে আসে ছবি, তাড়াতাড়ি সেটুকু দূরত্ব আবার পূরণ করে নেয়া উলফ বোট সরিয়ে নিয়ে। চিমনি আর টাওয়ারের সঙ্গে অদৃশ্য লাইন একটু এদিক ওদিক হলেই ঘটছে এটা। ছবি আর আলো আবার স্পষ্ট হলেই জাহাজ স্থির করে ফেলছে সে, দক্ষ হাত, সন্দেহ নেই। কাজটা যথেষ্ট কঠিন।
রোভারের অনেক ওপরে থাকতেই থেমে গেল মুসা। আর নামার সাহস হলো না। তার জানা আছে, মানুষের দেহের ওপর পানির চাপ অসহ্য হয়ে উঠলে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি জাগে, অনেকটা মাতলামির মত, তাল পায় না যেন শরীর। অতিআত্মবিশ্বাসী হয়ে তখন উল্টোপাল্টা অনেক কিছু করে বসতে পারে সাঁতারু, নিজের জীবন বিপন্ন করে তোলে নিজের অজান্তেই।
সেই পর্যায়ে যেতে চাইল না মুসা। অনেক নিচে রোডারের সার্চলাইটের আলো দেখতে পাচ্ছে। রোভারের ক্ষমতায় ঈর্ষা হলো তার। আফসোস করল, আহা তিমির মতই যদি মানুষের শরীরের গঠন হত, গভীর পানিতে সহজে নামতে পারত। তিমি ডাইভ দিয়ে এক মাইল গভীরেও নেমে যেতে পারে, ঘণ্টাখানেক সহজেই কাটিয়ে দিয়ে আসতে পারে এই ভয়ঙ্কর গভীরতায় অকল্পনীয় পানির চাপের মধ্যে।
ব্রীদিং টিউবটা সোজা করার চেষ্টা করল মুসা। বাকা পাইপটার পুরোটায় আঙুল বোলাল, একেবারে এয়ার ট্যাংকের গোড়া পর্যন্ত।
অদ্ভুত তো! ভাবল সে। পাইপে কোনরকম গিঁট নেই, জট নেই, তার পরেও…
উদ্বিগ্ন হয়ে আবার হাত বোলাল পাইপে, কোথাও একটা জট আছেই আছে, থাকতেই হবে, নইলে বাতাস পাচ্ছে না কেন ফুসফুস? শ্বাস নিতে পারছে না।
কোমরের ওয়েট বেল্টের বাকসে হাত দিল সে। শান্ত থাকার চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাল, দম বন্ধ রাখো। ভারিকেল্টটা খুলে ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে যাও ওপরে। আতঙ্কতি হয়ো না, গর্দভ কোথাকার! খোলো, খুলে ফেলো কেল্ট।
কিন্তু কথা শুনছে না আঙুল, অসাড় হয়ে গেছে। চোখেও কি গোলমাল হয়েছে। নইলে চারপাশের পানির রঙ বদলে যাচ্ছে কেন? হালকা গোলাপী থেকে লাল…তারপর গাঢ় লাল…গাঢ় হতে হতে এমন অবস্থা হলো, কালো মনে হচ্ছে লনকে…
বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস করছে সে। লাথি দিয়ে পা থেকে খুলে ফেলতে চাইছে ফ্লিপার। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ঠেলে উঠতে চাইছে ওপরে…
উজ্জ্বল আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখের সামনে। বুকে চাপ দিতে শুরু করেছে ভারি শক্ত কিছু। বুলডোজারের মত শক্তিশালী কিছু একটা ঠেলে তুলছে যেন তাকে ওপরে।
বাধা দিল না মুসা, দেয়ার সামর্থ্যও নেই। শরীরের শেষ শক্তি বিন্দু দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল ভারি জিনিসটাকে।