মুসা বলল, জোয়ার ছিল, না ভাটা?
অন্ধকার হয়ে এসেছিল, মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে উলফ। আর যা বড় বড় ঢেউ, ভালমত কিছু দেখারই উপায় ছিল না। তবে ঢেউয়ের মাথার যখন উঠে যাচ্ছিলাম, তখন তীর চোখে পড়ছিল। চেষ্টা করেও তীরের কাছে যেতে পারছিলাম না। বোধহয় ভাটাই ছিল তখন।
মনে মনে দ্রুত হিসেব শুরু করল কিশোর। ঝড়ের সময় উত্তর-পশ্চিম থেকে বইছিল হাওয়া, তীর বরাবর ঠেলে নেয়ার কথা দুজনকে। লাইফ-জ্যাকেট পরা ছিল, ওই অবস্থায় হাত পা নড়ানোই মুশকিল, নিশ্চয় সঁতরে বিশেষ এগোতে পারেনি। তাছাড়া ঢেউয়ের জন্যে এগোচ্ছে না পিছাচ্ছে সেটাও ভাল মত দেখার উপায় ছিল না। বলছে, দু-ঘন্টা ছিল পানিতে, ডাটা হলে ওই সময়ে অন্তত দুমাইল সরে গেছে সাগরের দিকে। কোস্ট গার্ডরা পেয়েছে ওদেরকে পাঁচ মাইল দূরে, তারমানে তীর থেকে তিন মাইল দূরে ডুবেছে বোট।
মুসাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল কিশোর। ফিসফিস করে জানাল।
ডেকে কয়েক মুহূর্ত পায়চারি করল মুসা, হিসেব করার ভান করল, তারপর আবার উলকের কাছে গিয়ে বলল, তীর থেকে মাইল তিনেক দূরে ডুবেছিল বোট, না?
জানলে কি করে? মুসার দিকে তাকাল উলক।
আপনার কথা থেকে।
হুঁ, আমারও তাই ধারণা, ঘড়ির দিকে চেয়ে কি হিসেব করল উলফ। এঞ্জিন নিউট্রাল করে নিল, মিনিটখানেক আপন গতিতে চলল ঘোট। এসে গেছি, টিনহার দিকে ফিরে বলল সে। মাছটাকে লাগাম… টিনহাকে কড়া চোখে চাইতে দেখে থেমে গেল। না, মানে স্তন্যপায়ী জীবটাকে পাঠানো যায় এবার। আমরা পৌঁছে গেছি।
এক জায়গায় ভাসছে এখন বোট, মৃদু ঢেউয়ে দুলছে।
রোভার, কাছে এসো, রোভার, টিনহা ডাকল। ডেকে ফেলে রেখেছে ক্যানভাসের কলারটা, টেলিভিশন-ক্যামেরা আর সার্চলাইট ওতে বেঁধে রেখেছে আগেই। ওগুলো তুলে নিয়ে পানিতে নামল সে। তিমির মাথা গলিয়ে পরিয়ে দেবে ক্যানভাসের কলার, সামনের দুই পাখনার ঠিক পেছনে রেখে শক্ত করে বাকলেস আটকে দিলে হাজার ঝাকুনিতেও আর খুলে আসবে না।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। তিন মাইল দূরে ডুবেছে বোট, কিন্তু কোন জায়গা থেকে তিন মাইল? উলফের স্পষ্ট ধারণা নেই। এখানে দু-পাশের দশ মাইলের মধ্যে যে কোন জায়গায় ডুবে থাকতে পারে। এতবড় এলাকায় ছোট্ট একটা বোট খোঁজা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার সামিল, সেটা তিমিকে দিয়ে খোঁজালেও।
কলার পরিয়ে ডেকে ফিরে এল টিনহা। তার পাশে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার বাবা আর কিছু বলতে পেরেছেন? ঝড়ের সময়কার কথা?
মাথা নাড়ল টিনহা। নাহ আর কিছু না। যা বলেছে, বলেছি তোমাকে।
কি বলেছে, মনে আছে কিশোরের। দুটো পোলের ওপর নজর রাখতে বলেছে। কিছু একটা নিশ্চয় বোঝাতে চেয়েছে। কি?
তিন মাইল দূরের তীরের দিকে তাকাল কিশোর।
তেমন কিছুই দেখার নেই। পাহাড়ের উঁচু উঁচু চূড়া, ওপাশে কি আছে কিছুই চোখে পড়ছে না, শুধু আরও উঁচু পর্বতের চূড়া ছাড়া। পাহাড়ের ওপর মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একআধটা নিঃসঙ্গ বাড়িঘর। টেলিভিশনের একটা রিলে টাওয়ার আছে, আরেক পাহাড়ের মাথায় একটা ক্যাকটরি, অনেক উঁচু চিমনি।
ওয়েট স্যুট পরে নাও, মুসা, কানে এল টিনহার কথা। এয়ার ট্যাংকগুলো চেক করে নেয়া দরকার।
পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়েই রয়েছে কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটার সময় এত জোরে টান মারছে, প্রায় থুতনির কাছে চলে আসছে ঠোঁট।
ক্যাপটেন শ্যাটানোগা অভিজ্ঞ নাবিক, ভাবছে কিশোর। বোট ডুবে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে নিশ্চয় কোন না কোন নিশানা রেখেছে। যদি খালি ভালমত কথা বলতে পারত…
টেলিভিশন টাওয়ার আর ফ্যাকটরির চিমনির ওপর দ্রুত বার দুই আসা যাওয়া করল কিশোরের দৃষ্টি। হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা।
দুই পোল!
প্রায় ছুটে এসে উলফের বাহু খামচে ধরল কিশোর। বোকা সেজে থাকার সময় এখন নয়। চেঁচিয়ে বলল, ওই পোল দুটো এক লাইনে আনু।
কি? বোকার মত কি ভ্যাড়ভাড় করছ?
বোট ডুবে যাওয়ার সময় লক্ষ রেখেছিলেন ক্যাপটেন শাটানোগা। চিহ্ন রেখেছিলেন। ওই যে টেলিভিশন টাওয়ার, আর ওই যে চিমনি।
কী।
দেখতে পাচ্ছেন না? কিশোরের মনে হলো এখন উলফই বোকার অভিনয় করছে। বোটটা পেতে চান? জাহাজ সরিয়ে নিন। ওই পোল দুটোর দিকে লক্ষ রেখে পিছান, এদিক ওদিক সরান, যতক্ষণ না জাহাজের সঙ্গে এক লাইনে আসে ও দুটো।
১২
বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। তিন মাইল দূরে তীরের দিকে নজর। জাহাজটা নড়ছে, টাওয়ার দুটোও সরছে। আরও একশো গজ-হিসেব করল সে, তারপরই এক লাইনে এসে যাবে দুটো।
হুইল ধরে রয়েছে উলফ।
গতি কমান, নির্দেশ দিল কিশোর। হ্যাঁ, এই গতি স্থির রাখুন।
একে অন্যের দিকে সরছে টাওয়ার দুটো। সরছে…সরছে…হ্যাঁ মিশে গেছে। চিমনিটার ঠিক সামনাসামনি হয়েছে টেলিভিশন টাওয়ার। জাহাজের সঙ্গে এক লাইন।
রাখুন, চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। রাখুন এখানেই, নড়াবেন না। চোখ থেকে ইনোকুলার সরাল সে।
পানি খুব গভীর, নোঙ্গর ফেলা গেল না। এঞ্জিন চাল রেখে যোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক জায়গায় রাখতে হবে জাহাজটাকে, হুইল ধরে রাখতে হবে সারাক্ষণ।
তীরের দিকে জাহাজের নাক ঘোরাল উলফ। চকচকে টাকটা কয়েক মিনিট আগে ভোতা ভেঁতা লাগছিল, এখন মনে হলো কিশোরের, বেশ জুলজুল করছে। মুখের ভাব টাকের চামড়ায় প্রকাশ প্রায় নাকি? ফিরে গিয়ে এ-ব্যাপারে পড়াশোনা করতে হবে, ঠিক করল সে। আর যা-ই হোক, সারেঙ হিসেবে উলফের জুড়ি কম, স্বীকার করতেই হলো তাকে। সেটা নিশ্চয় টাকের জন্যে নয়।