অন্ধকার থেকে আলোয় এসে চোখ মিটমিট করছে কিশোর। আবছা দেখল, খোলা দরজা দিয়ে উড়ে এসে পড়ল একজন মানুষ।
ডাইভ দিয়ে মোটা লোকটার গায়ে এসে পড়ল মুসা, তাকে নিয়ে ধড়াম করে পড়ল কাঠের মেঝেতে। সারা বাড়িটাই যেন কেঁপে উঠল থরথর করে। মুসার পেছনে ছুটে ঢুকল রবিন।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আগেও অনেকবার পড়েছে, জানা আছে কি করতে হয়। এক সঙ্গে রইল না ওরা। তিনজুন তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ে ছুটল। ধরা পড়লে একজন পড়বে। পেছনে প্রচণ্ড কাচকোচ শুনে একবার ফিরে তাকাল কিশোর। নড়বড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে দৈত্যটা। এলোমেলো পদক্ষেপ। টলছে। পেটে মুসার আফ্রিকান খুলির জুতসই একখান ওঁতো খেয়েছে, সুস্থির হতে সময় লাগবে।
ওই যে তোমার সাইকেল, ছুটতে ছুটতেই হাত তুলে কিশোরের সাইকেল দেখাল রবিন। তার আর মুসারটাও রয়েছে ওখানেই।
টান দিয়ে যার যার সাইকেল তুলে নিয়ে লাফিয়ে চড়ে বসল ওরা। শাঁই শাঁই করে প্যাডাল ঘোরাল। দৈত্যটা আসছে কিনা দেখারও সময় নেই, প্রাণপণে ছুটে চলল অন্ধকার পথ ধরে।
১১
প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম, বলল রবিন। তোমার সাইকেলটা দেখলাম মঞ্চের গায়ে ঠেকা দেয়া। চকের চিহ্ন দেখে ঢুকেছি, কিন্তু কোন পথে বেরিয়েছ, তার কোন চিহ্ন নেই।
মাথা নাড়ল কিশোর। যাওয়ার আগে বুদ্ধি করে তোমাদের জানিয়ে ভালই করেছি, বেঁচে গেছি, নইলে যা বিপদে পড়েছিলাম।
কথা হচ্ছে পরদিন সকালে। ছোট খাঁড়িটার কাছে এসে বসে আছে ওরা। পরনে সাঁতারের পোশাক।
আগের দিন রাতে বাড়ি ফিরেই টিনহাকে ফোন করেছে কিশোর, জানিয়েছে সে ভাল আছে। বোট খুঁজতে যাওয়ায় আর কোন অসুবিধে নেই।
রবিন বুঝতে পেরেছে আগে, কিশোরকে জানাল মুসা। পথে তেলের দাগ দেখতে পেলাম। কাছেই চকের দাগ। রবিন অনুমান করল, পুরানো একটা গাড়ি পঁড়িয়েছিল ওখানে, এঞ্জিন থেকে তেল ঝরে।
তা বুঝেছি, রবিন বলল, কিন্তু একশ গজ দূরে আরেকটা তেলের দাগ। আবিষ্কার করেছে মুসাই। ওটা না দেখলে তোমাকে খুঁজে পেতাম না। দুগ ধরে এগিয়ে গেলাম। দেখি, ভাঙা বাড়ির ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে ঝরঝরে একটা লিমোসিন।
শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল ওরা। একটা ট্রাক, কাঁচা রাস্তা ধরে পরে ধীরে পিছিয়ে আসছে, এদিকেই। ট্রাকের পেছনে ফোম-রবারে আবৃত রোভার। ওর চোখ বন্ধ, ভাব দেখে মনে হচ্ছে যে আরামেই আছে।
সৈকতের সরু চিলতেটুকু পেরিয়ে পানির কিনারে নেমে গেল ট্রাক। পেছনের চাকার অ্যাকসেল এখন পানির নিচে। খাঁড়ির এই পারটা বেছে নিয়েছে টিনহা, তার কারণ জায়গাটা খুব ঢালু। কিনার থেকে কয়েক গজ দূরেই পানি এত বেশি গভীর, সহজেই সাঁতরাতে পারবে রোভার।
ট্রাক থেকে নামল টিনহা আর তার মেকলিকান বন্ধু। টিনহার পরনে সাঁতারের পোশাক, গলায় ঝুলছে স্কুবা গগলস। ঘুরে ট্রাকের পেছনে চলে এল সে, পানিতে দাঁড়িয়ে আলতো চাপড় মেরে আদর করল রোভারকে।
মস্ত বড় ট্রাক, ক্রেনও আছে। হাত তুলে মুসাকে ডাকল টিনহা। কাছে গিয়ে দেখল মুসা, বেশ চওড়া একটা ক্যানভাসের বেল্ট আটকে দেয়া হয়েছে রোভারের শরীরের মাঝামাঝি এমন জায়গায়, যাতে ওটা ধরে ঝোলালে দুদিকের ভারসাম্য বজায় থাকে।
মুসাকে সাহায্য করতে বলল টিনহা।
মুসা আর মেকসিকান লোকটা মিলে ক্রেনের হুক ঢুকিয়ে দিল ক্যানভাসের বেল্টের মধ্যে, রোভারের পিঠের কাছে। এঞ্জিন চালু করে টান দিতেই শুন্যে উঠে গেল রোভার। তার মাথায় আরেকবার চাপড় দিয়ে ভয় পেতে নিষেধ করল টিনহা।
সামান্যতম উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না তিমিটাকে। চোখ মেলে দেখছে লেজ নাড়ছে। কিশোর আর রবিনও এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে। তিন কিশোর মিলে ঠেলে বুলন্ত তিমিটাকে নিয়ে গেল বেশি পানির ওপর। চেঁচিয়ে নামানোর নির্দেশ দিন টিনহা ক্রেন ড্রাইভারকে।
আস্তে করে পানিতে নামিয়ে দেয়া হলো রোভারকে। বেল্ট খুলে দিল মুসা। সাঁতরাতে শুরু করল তিমি, আবার নিজের জগতে, স্বাধীন খোনা দুনিয়ায় ফিরে এসেছে। এক ছুটে চলে গেল কয়েক গজ দুরে।
রোভার, রোভার, দাঁড়াও, ডাকল টিনহা।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল রোভার। শরীর বঁকিয়ে ঘুরে গেল মুহর্তে, ছুটে এল, কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা টিনহার গায়ে মুখ ঘষল। মাথায় চাপড় মেরে ওকে আদর করল টিনহা।
ও-কে,মেকসিকান বন্ধুকে বলল টিনহা, মুচাস গ্রেশাস!
হেসে গিয়ে ট্রাকে উঠল মেকসিকান। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, বুয়েনা সুয়েরটি, স্টার্ট দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল সে।
রেডি? তিন গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করল টিনই। সাগরের দিকে চেয়ে দেখল, একশো গজ দূরে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে উলফের কেবিন ক্রুজার। কিশোর, টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে নাও। রোভার আমার কাছছাড়া হবে না, জানি, তবু যন্ত্রটা সঙ্গে থাকা ভাল। বলা তো যায় না।
আমি বলি কি, পানিতে টিনহার পাশে চলে এল কিশোর।
কি?
ভেবে দেখলাম, রেকর্ডারটা নিয়ে রবিনের এখানে থাকা উচিত।
কেন?
কেন, সেটা বলল কিশোর। উলফকে বিশ্বাস কি? একাই হয়তো মেকসিকো উপকূলে গিয়ে ক্যালকুলেটরের চালান দিয়ে আসতে পারবে, ক্যাপটেন শ্যাটানোগার দরকার পড়বে না। সেক্ষেত্রে আপনার শেয়ার মারা যেতে পারে। রবিন থাক এখানে।