অন্ধকারে হাতড়াতে শুরু করল কিশোর। একটু পরেই পেয়ে গেল যা খুজছিল। কোমরের কেট থেকে আট-ফলার প্রিয় দুরিটা খুলে একটা বাকা কলা দিয়ে খোচাতে লাগল কানের গায়ে। ছোট একটা ছিদ্র করে ফেলল।
পুরানো গাড়ি, বুটের ভেতরটা আরও পুরানো। মেঝেতে মরচে, রঙ করার তাগিদ নেই মালিকের। কিশোরের জন্যে সহজই হয়ে গেল। ছুরির আরেকটা ফলা ব্যবহার করে মেঝেতেও আরেকটা গর্ত করে ফেলল সে।
ক্যানের ছিদ্রটা অনুমানে রাখল মেঝের গর্তের ওপর। অল্প অল্প করে তেল ঝরতে লাগল রাস্তার ওপর, ক্যানের মুখ দিয়ে ঢাললে হড়হড় করে অনেক বেশি পড়ে যেত, তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত তেল, তাই ছিদ্র করে নিয়েছে। যাক, একটা চিহ্ন রেখে যেতে পারছে। রাস্তায় পড়ে শুকিয়ে যাবে, কিন্তু আবছা একটা চিহ্ন থেকে যাবেই।
আস্তে চলছে গাড়ি, জোরে চলার ক্ষমতাই নেই বোধহয় এঞ্জিনের। খুব বেশি দূর গেল না। ক্যানটা মাত্র অর্ধেক খালি হয়েছে। বেশ জোরেশোরে একটা দোল দিয়ে থেমে দাঁড়াল আদ্যিকালের লিমোসিন।
বুটের ডালা উঠল আবার। চুল খামচে ধরে টান দিল লোকটা। বেরোও।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল কিশোর। কেউ তার চুল টানুক, মোটেও পছন্দ করে না সে।
টলমল পায়ে খাড়া হলো কিশোর। যেন এই মাত্র হুঁশ ফিরেছে। ভাঙাচোরা একটা কাঠের বাড়ির ড্রাইভ-ওয়েতে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। চুল ছাড়েনি লোকটা, আবার যদি কেহঁশ হয়ে যায় কিশোর, এই আশঙ্কায় বোধহয়। টেনে, ঠেলে-ধাক্কিয়ে তাকে নিয়ে এসে তোলা হলো বাড়ির বারান্দায়। ক্যাঁচকোঁচ করে আপত্তি জানাল জীর্ণ বারান্দা। কিশোরের ভয় হলো, ভেঙে না পড়ে।
চাবি বের করে দরজা খুলল লোকটা। ঢোকো। চুল ধরে জোরে ঠেলে দিল কিশোরকে ঘরের ভেতর।
অন্ধকারে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হলো। সুইচ টেপার খুট শব্দ, আলো জ্বলল।
প্রথমেই লোকটার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। কেন তার চেহারা লেপটানো মনে হয়েছে বোঝা গেল। কাল একটা মোজা টেনে দিয়েছে মাথার ওপর দিয়ে। গোটা তিনেক ফুটো, দুটো চোখের কাছে, একটা নাকের কাছে।
আলোয় আরও বিশাল মনে হচ্ছে লোকটাকে। কিন্তু এত নরম কেন শরীর, চামড়ার নিচে খালি চর্বি, মাংস নেই?
ঘরের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর, কি আছে না আছে দেখে নিল। কয়েকটা কাঠের চেয়ার, একটা পুরানো টেবিল-ঠেলা দিলেই হয়তো বুড়ো মানুষের দাতের মত নড়ে উঠবে, তাতে একটা টেলিফোন, জানালায় মলিন পর্দা। নোংরা দেয়াল। লোকটা বোধহয় থাকে না এখানে।
ওদিকে, হাত তুলে আরেকটা দরজা দেখাল দৈত্য।
কিশোরকে ঠেলে দরজার কাছে নিয়ে এল সে, এক ধাক্কায় ভেতরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিল পান্না। বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল।
আবার অন্ধকারে এসে পড়েছে কিশোর। হাতড়ে হাতড়ে আবিষ্কার করল, ছোট্ট একটা ঘরে ঢোকানো হয়েছে তাকে, চিলেকোঠার চেয়ে ছোট।
হাল্লো, বাইরের ঘরে দৈত্যটার গলা শোনা গেল, টেলিফোনে কথা বলছে। মিস টিনহা শ্যাটানোগা আছে?
দরজায় কান পেতে দাঁড়াল কিশোর।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর আবার শোনা গেল, মিস শ্যাটানোগ্য, আপনার বন্ধু কিশোর পাশা এখন আমার এখানে বন্দি। বন্দিকে বলল বন্দি।
নীরবতা।
হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, মিস, কিডন্যাপ করেছি আমি। কিডন্যাপকে বলল কিডনে-আপ।
আবার নীরবতা।
না, টাকা চাই না। শর্ত একটাই তিমিটাকে সাগরে ছেড়ে দিতে হবে, এখুনি। আর আপনার বাবার বোট খোঁজা চলবে না।
দীর্ঘ নীরবতা।
তাহলে আপনার কিশোর বন্ধুকে আর দেখবেন না, মানে জ্যান্ত দেখবেন না। রিসিভার রেখে দেয়ার শব্দ হলো।
রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে তিন গোয়েন্দা। বিপদে পড়েছে। উদ্ধারও পেয়েছে কোন না কোনভাবে। এবারে কি ঘটবে জানে না কিশোর। তবে টিনহা দৈত্যটার কথা না শুনলে সে যে কিশোরকে খুন করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। মিথ্যে হুমকি দেয়নি লোকটা, কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেছে।
আলোচনার সময় সেদিন মুসা আর রবিনকে বলেছিল কিশোর, তিনটে লোককে সন্দেহ করে সে। দুজনের নাম বলেছে, আরেকজনের বলেনি। তৃতীয় লোকটা সেই রহস্যময় ব্যক্তি, যে ফোন করে তিমিটাকে ছেড়ে দিতে বলেছে, একশো ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এই দৈত্যটাই সেই লোক।
লোকটা চায় না ক্যাপটেন শ্যাটানোগার বোট উদ্ধার হোক। সেজন্য দরকার হলে মানুষ খুন করতেও পিছপা হবে না। এক বার তো করেই ফেলেছিল প্রায়, টিনহার পিকআপের ব্রেক নষ্ট করে দিয়ে।
আট ফলার দুরি খুলে নিল আবার কিশোর। তালা খোলার চেষ্টা করবে।
নোকটা দৈত্য, কিন্তু সেই তুলনায় স্বাস্থ্য ভাল না, পেশী বহুলনা। হয়তো হয়তো আচমকা ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া যাবে আশা করল কিশোর, তারপর দেবে ঝেড়ে দৌড়। কিন্তু আগে তালা খুলতে হবে।
দুরির একটা সরু ফলা তালার ভেতরে ঢুকিয়ে নিঃশব্দে চাড় দিল কিশোর, খুঁচিয়ে চলল নীরবে।
বাইরের ঘরে পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, মচমচ করছে কাঠের মেঝে। ফলে তালা খোলার চেষ্টায় অতি সামান্য শব্দ যা হচ্ছে, সেটা ঢেকে যাচ্ছে।
হঠাৎ, আর সাবধানতার প্রয়োজন দেখল না কিশোর। মড়াৎ করে ভাঙল কি যেন পাশের ঘরে। কাঠের কিছু ভেঙেছে। কি ব্যাপার? লোকটা মেঝে ভেঙে নিচে পড়ে গেল নাকি?
তালা ল গেল। হাতল ধরে হ্যাচকা টানে দরজা খুলে ফেলল কিশোর। সেও ঢুকল বড় ঘরে, আর অমনি ঝটকা দিয়ে প্রায় ভেঙে খুলে ছিটকে পড়ল বাইরের দরজা।