তিন গোয়েন্দার তিনজনেই পকেটে চক রাখে, একেকজন একেক রঙের। কিশোর রাখে সাদা, রবিন সবুজ, মুসা নীল। কোন কেসের তদন্তের সময় কেউ
কোন বিপদে পড়লে অনেক কাজে লাগে এই চক আর আশ্চর্যবোধক চিহ্ন।
পার্কে ঢোকার পথের সন্ধান পাওয়া গেল। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না, তবে দু-ধারে স্ট্রীট লাইট দেখে অনুমান করে নিল, পথটা কোথায় থাকতে পারে। কাছে এসে দেখল, দুপাশ থেকে এসে পথের প্রায় পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে আগাছা আর লতা ঝোপ, মাঝখানের সরু একটুখানি শুধু বাকি। এগিয়ে চলল সে। খানিক পর পরই একটা করে আশ্চর্যবোধক একে দিচ্ছে গাছের গায়ে, কিংবা ভাঙা কোন বেঞ্চিতে।
কল্পনা-বিলাসী নয় কিশোর। বাস্তবতার বাইরে কোন কিছুই বিশ্বাস করে না। ঝোপকে ঝোপই মনে করে, লুকানোর খুব ভাল জায়গা, বিষাক্ত সাপখোপ থাকতে পারে ভেতরে, তবে তৃত থাকে না।
কিন্তু হাজার হোক মানুষের মন, হোক না সেটা কিশোর পাশার। নির্জন জংলা পার্কের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অকারণেই গা ছম ছম করে উঠল তার। মনে হলো, আশেপাশের সব কিছুই যেন জীবন্ত, নড়ছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। গাছের বাকা ডালগুলো যেন কোন জীবের পঙ্গু হাত-পা। ছোট ছোট শাখাগুলো আঙুল, তাকে আঁকড়ে ধরে ছিনিয়ে যাওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে, ধরতে পারলেই টেনে নিয়ে গিয়ে ভরবে অন্ধকার জঠরে।
অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। সামনে মঞ্চটা দেখতে পেল কিশোর। ছাউনি ধসে পড়েছে, চারপাশে আগাছার জঙ্গল, আর কিছুদিন পর একেবারে ঢেকে যাবে। তখন মনে হবে ঘাসের একটা উঁচু ঢিপি।
মঞ্চের গায়ে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে ভাঙা একটা কাঠের বোর্ডে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকল।
কিশোর পাশা।
এতই চমকে উঠল কিশোর, ঘুরতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় আরেকটু হলেই ফেলে দিয়েছিল সাইকেলটা। চারপাশের বিষঃ অন্ধকারে লোকটাকে খুঁজল তার চোখ, কিন্তু দেখা গেল না।
কে কোনমতে বলল।
খসখস শব্দ শোনা গেল। লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে। গজখানেকের মধ্যে আসার পর একটা মানুষের অবয়ব চোখে পড়ল কিশোরের।
খুব লম্বা, মাথায় হ্যাটের কিনারা নিচু হয়ে নেমে এসেছে কানের ওপর। চোখ দেখা যাচ্ছে না, চেহারাও বোঝা যাচ্ছে না, নাক মুখ কিছুই যেন নেই, লেপটানো। অদ্ভুই।
লোকটা বিশালদেহী। গায়ে উইণ্ডব্রেকার, কাঁধ এত চওড়া, আর এত মোটা বাহু, কিশোরের মনে হলো একটা গরিলা, মানুষ নয়।
এগোও, কিশোর, বলল লোকটা। যা নিতে এসেছ নিয়ে যাও। কথাবার্তাও জানি কেমন।
আগে বাড়ল কিশোর।
চোখের পলকে তার কাঁধ চেপে ধরে এক ঝটকায় তাকে লাঠুর মত ঘুরিয়ে ফেলল লোকটা। ঘাড় চেপে ধরল। পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে লোকটার বাহু খামচে পরে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিশোর। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। নরম পাউরুটির ভেতরে দেবে গেল যেন তার আঙুল।
ছটফট শুরু করল কিশোর, ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাল। লোকটার আরেক হাত গলা চেপে ধরল তার। হাতের আঙুলগুলো হাভিডসর্বস্ব। অবাক কাণ্ড! এত মোটা লোকের এই আঙল।
পুরো অসহায় হয়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধান।
যা করতে বলব, ঠিক তাই করবে, বলল আগন্তুক।
মাথা নুইয়ে আচ্ছা বলার চেষ্টা করল কিশোর, পারল না। হ্যামারলকে আটকে ফেলা হয়েছে তাকে।
যদি না করো, কানের কাছে গোঙাল লোকটা, যা বলব যদি না করো, ঘাড় মটকে দেব। ঘাড় মটকের উচ্চারণ মনে হলো অনেকটা ঘাড়ম-টকে।
১০
যা যা করতে বলা হলো, ঠিক তাই করল কিশোর।
মঞ্চের কাছ থেকে হেঁটে চলল, যে পথে এসেছে, সেটা নয়, অন্য পথে। আরেকটা গাছের গায়ে আচযবোধ আঁকার সুযোগ খুজছে। কিন্তু পকেট থেকে চক বের করার সুযোগ নেই। অন্য কায়দার ধরেছে এখন তাকে লোকটা, ডান হাত মুচড়ে নিয়ে এসেছে পিঠের ওপর, একেবারে শোল্ডার ব্লেডের কাছাকাছি। ব্যথা পাচ্ছে কিশোর।
পার্কের বাইরে পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরানো ঝরঝরে লিমোসিন।. কিশোরকে গাড়িটার কাছে নিয়ে এল লোকটা। হাত মুচড়ে ধরে রেখেই আরেক হাতে পকেট থেকে চাবিবের করে বুটের তালা খুলল।
ঢোকো, আদেশ দিল লোকটা।
পথের শেষ মাথার দিকে তাকাল কিশোর। কেউ নেই। সাহায্যের জন্যে ঙ্গিকার করে লাভ হবে না।
হাতে সামান্য ঢিল পড়ল। টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল কিশোর, লোকটাও অবশ্য ছেড়ে দিল। বিশাল, তুলতুলে নরম বুকের চাপ রেখেছে কিশোরের পিঠে, হাত মুক্ত হলেও পালাতে পারবে না কিশোর। পেট আর বুক দিয়ে ঠেলছে লোকটা, তাকে বুটে ঢোকার জন্যে। আরেকটু হলেই ভারসাম্য হারিয়ে ভেতরে পড়বে কিশোর।
আঁউ, করে হাত-পা ছেড়ে দিল কিশোর, যেন সহসা জ্ঞান হারিয়েছে। পড়ে গেল পথের ওপর, মুখ গুজে রইল। পড়ার সময়ই চক বের করে ফেলেছে, ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিয়েছে গাড়ির তলায়। পথের ওপর একটা আশ্চর্যবোধক একে ফেলল।
দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল লোকটা, ভাবছে কি করবে। ছেলেটা হঠাৎ এভাবে বেহুশ হয়ে পড়বে, আশা করেনি।
কিশোরের ঝাকড়া চুল ধরে টেনে তুলল সে, প্রায় ছুঁড়ে ফেলল বুটের মধ্যে। দড়াম করে নামিয়ে দিল ডালা।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
বুটের ভেতরে ঘন অন্ধকার, অপরিসর জায়গা, তার ওপর পোড়া মোটর অয়েল আর পেট্রলের তীব্র গন্ধ, পাক দিয়ে ওঠে নাড়ীভুড়ি। পোড়া গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে, তেল খাওয়ার রাক্ষস গাড়িটা। গ্যালনে দশ মাইল যায় কিনা সন্দেহ। এ সমস্ত গাড়িতে আলাদা ট্রেল ক্যান রাখে লোকে।