বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন। হ্যাঁ, আরও অন্তত ছয় ঘণ্টা।
শুকনোয় এতক্ষণ বাঁচতে পারে তিমি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মনে হয় না। পানি না পেলে খুব তাড়াতাড়ি ডি-হাইড্রেটেড হয়ে পড়ে ওদের শরীর, চামড়া শুকিয়ে খসখসে হয়ে যায়।
ঝুঁকে বিশাল মাথাটায় আলতো চাপড় দিল রবিন, দুঃখ হচ্ছে তিমিটার জন্যে। পানিতে রাখতে হবে, নইলে বাঁচবে না।
কথা বুঝতে পেরেই যেন ক্ষণিকের জন্যে চোখ মেলল তিমি। বিষণ্ণ হতাশা মাখা দৃষ্টি, রবিনের তা-ই মনে হলো। ধীরে ধীরে আবার চোখের পাতা বন্ধ করল তিমিটা।
কিভাবে রাখব। বলল মুসা, পানিতে যখন ছিল তখনই ঠেলে সরাতে পারিনি, আর এখানে তো খটখটে শুকনো।
জবাব দিতে পারল না রবিন। কিশোরের দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ কোন কথা বলছে না গোয়েন্দাপ্রধান, তাদের আলোচনায় মন নেই।
গভীর চিন্তায় মগ্ন কিশোর, ঘন ঘন তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। বিড়বিড় করল, পর্বতের কাছে যদি যাওয়া না যায় পর্বতকেই কাছে আনতে হবে।
আরে, এই কিশোর, জোরে বলল মুসা, কি বলছ? ইংরেজী বললো, ইংরেজী বললো। এখানে কিসের পর্বত? আমরা পড়েছি তিমি-সমস্যায়।
মাঝে মাঝে কঠিন শব্দ বলা কিংবা দুর্বোধ্য করে কথা বলা কিশোরের স্বভাব।
তিমির কথাই তো বলছি। সাগরে দেখাল কিশোর, ওই যে, পর্বত, ওটাকেই কাছে আসতে বাধ্য করতে হবে। একটা বেলচা দরকার। আর…আর একটা তুরপুলিন। আর পুরানো একটা হ্যাণ্ড পাম্প, গত মাসে যেটা বাতিল মালের সঙ্গে কিনে এনেছে চাচা…
গর্ত, চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
গর্ত! কিসের গর্ত? মুসা অবাক।
একটা গর্ত খুঁড়ে, তাতে তারপুলিন বিছিয়ে পাম্প করে পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে গর্তটা, বলল কিশোর। ছোটখাট একটা সুইমিং পুল বানিয়ে দেব তিমিটার জন্যে, যতক্ষণ না জোয়ার আসে টিকে থাকতে পারবে।
দ্রুত সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর ঠিক হলো, সাইকেল নিয়ে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসবে মুসা আর রবিন। ততক্ষণ তিমিটাকে পাহারা দেবে কিশোর।
মুসা, রবিন চলে গেল। কিশোর বসে রইল না। প্লাসটিকের একটা বাঁকাচোরা বাকেট খুঁজে আনল খাঁড়ি থেকে। হাত দিয়ে চেপেচুপে কোনমতে কিছুটা সোজা করে নিয়ে ওটাতে করে পানি এনে গায়ে ছিটাল তিমিটার।
পরের আধ ঘণ্টা পানি ছিটানোয় ব্যস্ত রইল কিশোর। রবিন আর মুসা যা করতে গেছে, তার চেয়ে কঠিন কাজ করতে হচ্ছে তাকে, সন্দেহ নেই। ঢালু ভেজা পাড় বেয়ে সাগরে নেমে পানি তুলে নিয়ে দৌড়ে ফিরে আসতে হচ্ছে, এতবড় একটা শরীর ভিজিয়ে রাখা সোজা কথা নয়। ছোট বাকেটে কতটুকুই বা পানি ধরে, তার ওপর তিমির চামড়া যেন মরুভূমির বালি, পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুঁষে নিচ্ছে।
গতর খাটাতে কোন সময়েই বিশেষ ভাল লাগে না কিশোরের। ঠেকায় পড়লে কাজ করে, তার চেয়ে মগজ খাটানো অনেক বেশি পছন্দ তার। ওই যে, এসে গেছে, তিমিটাকে বলল সে।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল দুই সহকারী গোয়েন্দা। যা যা দরকার নিয়ে এসেছে। প্রায় নতুন একটা বেলচা, তারপুলিনের রোল, হ্যাণ্ড-পাম্প, হোস। পাইপের কুণ্ডলী নামিয়ে রাখল বালিতে।
কিশোরও হাঁপাচ্ছে। বলল, ওটার গা ঘেষে গর্ত খুঁড়তে হবে। তারপর যে ভাবেই হোক ঠেলেঠুলে ফেলব গর্তে। তিনজনের মাঝে গায়ে জোর বেশি মুসার, কায়িক পরিশ্রমেও অভ্যস্ত, বেলচাটা সে-ই আগে তুলে নিল। গর্তের বেশির ভাগটাই সে খুঁড়ল। ভেজা বালি, আলগা, খুঁড়তে বিশেষ বেগ পেতে হলো না, সময়ও লাগল না তেমন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দশ ফুট লম্বা, তিন ফুট চওড়া আর তিন ফুট মত গভীর একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলল ওরা।
গর্তে তারপুলিন বিছিয়ে দিল ভালভাবে, চারপাশের দেয়ালও তারপুলিনে ঢাকা। পড়ল, ফলে পানি শুঁষে নিতে পারবে না বালি। পাম্প নিয়ে সাগরের দিকে দৌড়াল মুসা। রবিন আর কিশোর হোস পাইপের কুণ্ডলী খুলল, পাম্পের সঙ্গে এক মাথা লাগিয়ে আরেক মাথা টেনে এনে ফেলল গর্তে। পাম্পটা বেশ ভাল, কোন মাছধরা নৌকায় পানি সেঁচার কাজে ব্যবহার হত হয়তো।
পালা করে পাম্প করে অল্পক্ষণেই গর্তটা পানি দিয়ে ভরে ফেলল ওরা।
সব চেয়ে শক্ত কাজটা এবার, ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।
আল্লাহ ভরসা, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল মুসা। এসো ঠেলা লাগাই।
দাঁড়াও, একটু জিরিয়ে নিই, ধপাস করে বালিতে বসে পড়ল কিশোর। আর কয়েক মিনিটে মরবে না।
জিরিয়ে নিয়ে উঠল ওরা। ভারি পিপে ঠেলে গড়িয়ে নেয়ার ভঙ্গিতে তিমির গায়ে হাত রেখে দাঁড়াল কিশোর আর মুসা। মাথার কাছে চলে এল রবিন। তিমির মাথায় আলতো চাপড় দিল।
চোখ মেলল তিমি। রবিনের মনে হলো, তার দিকে চেয়ে হাসছে।
ঠেলো বললেই ঠেলা লাগাবে। এক সঙ্গে… কিন্তু কিশোরের কথা শেষ হলো না। তার আগেই ভীষণভাবে নড়ে উঠল তিমি। বান মাছের মত মোচড় দিয়ে শরীর বাঁকিয়ে, বালিতে লেজের প্রচণ্ড ঝাপটা মেরে পাশে সরে গেল, ঝপাত করে কাত হয়ে পড়ল পানিতে। পানি ছিটকে উঠল অনেক ওপরে।
তিমির গায়ে বেশি ভর দিয়ে ফেলেছিল মুসা, উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আবার। চেঁচিয়ে উঠল, ইয়াল্লা!
আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল রবিন।
হাতের তালু ঝাড়তে ঝাড়তে কিশোর বলল, যাক বাবা, বাঁচা গেল। নিজের কাজ নিজেই সেরে নিল।