তুমি জানলে কি করে? মোড়ের কাছেই ছিলাম আমরা। আপনাকে পিকআপ নিয়ে যেতে দেখেছি।
অ। তোমাদের নাকের ডগা দিয়েই গেছি তাহলে, থামল টিনহা। আর কিছু বলবে?
আপনার বাবার সম্পর্কে। উলফকে শেষ কবে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনার বাবা যেবার তাঁর বোট ডুবেছে?
দীর্ঘ নীরবতা। মনে করার চেষ্টা করছে বোধহয় টিনহা। বলতে পারব না। মাঝেমধ্যেই কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন আর স্যান পেড্রোতে যাওয়া সম্ভব হয় না। সান্তা মনিকায় আমার এক বান্ধবীর ঘর শেয়ার করি। প্রতি সোমবারে বাবাকে দেখতে যেতাম স্যান পেড্রোতে। কিন্তু সেবার সান ডিয়েগোতে গিয়েছিলাম, বাড়ি যাইনি। দু-হপ্তা বাবার খোজ নিতে পারিনি, তারপর হাসপাতাল থেকে ফোন এল… কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল তার। মর্মান্তিক সেই মুহূর্তটা মনে পড়েছে হয়তো।
সহানুভূতি দেখিয়ে চুপ করে রইল কিশোর, টিনহাকে সামলে নেয়ার সময় দিল। কোন দিকে নিয়ে যা বুঝাতে পারছি। পুরো চোদ্দ-পনেরো দিনই হয়তো বাবা আর উল সাগরে ছিল, এবং সেটা জানার উপায় ছিল না, এই তো?
তাই নয় কি? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
ব্যাপারটা খুব জরুরী?
জরুরী, জানাল কিশোর।
টিনহা লাইন কেটে দেয়ার পরও অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল গোয়েন্দা প্রধান, গভীর ভাবনায় ডুবে রইল। সত্যিই কি বাজায় গিয়েছিল ক্যাপটেন আর উল? ফেরার পথেই ঝড়ে পড়েছিল? জানতে হবে।
কিন্তু কিভাবে? মুখ তুলে তাকাল মুসার দিকে। মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। যাবে?
নিশ্চই? উঠে দাঁড়াল মুসা। যাব না মানে।
রবিন?
যাব, বিখ্যাত চিত্রপরিচালককে সাহায্যের অনুরোধ করবে, বুঝতে পারছে রবিন, কিন্তু একটা কথা ভুলে যায়নি। তিনজন সন্দেহভাজনের মধ্যে দুজনের নাম উল্লেখ করেছে কিশোর, আরেকজন কে?
কিশোর, এক সেকেণ্ড, বলল রবিন। আরেকজন কাকে সন্দেহ করছ?
দুই সুড়ঙ্গের পান্না তুলে ফেলেছে কিশোর, রবিনের কথার জবাব দিল না। অদৃশ্য হয়ে গেল সুড়ঙ্গের ভেতরে।
হুঁ, বেশ জটিলই মনে হচ্ছে, সব শুনে বললেন ডেভিস ক্রিস্টোফার। বলো, দেখি কিছু করা যায় কিনা।
পর পর কয়েকটা ফোন করলেন তিনি বিভিন্ন জায়গায়। তারপর বেয়ারাকে ডেকে আইসক্রীম আনতে বললেন। বিশাল টেবিলে তার সামনে পড়ে থাকা খোলা ফাইলটা আবার টেনে নিতে নিতে বললেন, তোমরা খাও, আমি কাজটা সেরে নিই, খুব জরুরী। চিন্তা নেই, খবর এসে যাবে।
ধীরে ধীরে খেলো ছেলেরা। কাজ করেই চলেছেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। চুপচাপ বসে থেকে তাদের সময় আর কাটতে চাইছে না। কথাও বলতে পারছে না, চিত্রপরিচালকের কাজের অসুবিধে হবে। অস্বস্তিকর পরিবেশ। কিশোর প্রায় বলেই ফেলেছিল, আমরা এখন যাই, বাড়ি গিয়ে ফোন করে খবর জেনে নেব, ঠিক এই সময় বাজল ফোন।
রিসিভার তুলে নিলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। নীরবে শুনতে লাগলেন ওপাশের কথা শুনছেন, মাঝে মধ্যে হাঁ করছেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে ছেলেরা, মুসা কাত হয়ে গেছে একপাশে, যেন ওভাবে ঝুঁকে কান খাড়া করলেই রিসিভারের কথা শোনা যাবে।
অবশেষে রিসিভার নামিয়ে ছেলেদের দিকে তাকালেন মিস্টার ক্রিস্টোফার, খবর কিছু পেয়েছি। কিন্তু তোমাদের কেসে এটা কি করে ফিট হবে বুঝতে পারছি না।
কি খবর, স্যার? উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে এল কিশোর, আর ধৈর্য ধরতে পারছে না।
মেকসিকান ইমিগ্রেশন অথরিটির কাছে ফোন করেছিলাম। খোজ নিয়েছে ওরা। ফেব্রুয়ারির দশ তারিখে ক্যাপটেন শ্যাটামোগার বোটে উঠেছিল বিংগো উলফ। লা পাজে, বন্দরে ছিল দুদিন, বারোই ফেব্রুয়ারি রওনা হয়েছে।
মাথা নোয়াল কিশোর, কুটি করল। থ্যাংক ইউ, স্যার, বলল সে। ক্যাপটেন শ্যাটানোগার বোট ডুবেছে সতেরো তারিখে, নিঃসন্দেহ বাজা থেকে ফেরার পথে। স্যান পেড্রোতে ফিরছিল, এই সময় ঝড়ে পড়ে বোট। মূসা আর রবিনের দিকে তাকাল। আমার যা মনে হয়, মেকসিকো উপকূলের কাছেই কোথাও মাল চালান দেয়। তবে, আবার চিত্রপরিচালকের দিকে ফিরল সে, সেবার বোধহয় কোন কারণে মাল নামাতে পারেনি। ওগুলো নিয়েই আবার ফেরত আসছিল। কিংবা মিছে কথা বলেছে উলফ, ক্যালকুলেটরগুলো আদৌ নেই জাহাজে। আপনার কি মনে হয়, স্যার?
বুঝতে পারছি না, হাসলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। প্রথমেই তো বললাম, এবারের কেসটা বেশ জটিল।
আমার কাছেও পরিষ্কার হয়নি এখনও, উঠল কিশোর। তো আমরা আজ যাই, স্যার।
এসো।
দরজার দিকে চলল তিন গোয়েন্দা। পেছন থেকে চেয়ে আছেন চিত্রপরিচালক মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটে। বিড় বিড় করলেন, ছেলে একখান। ওর পেট থেকে কথা আদায় করা ফাইলটা টেনে নিলেন আবার।
৯
কি বুঝলি, কিশোর? মেরিচাচী বললেন। পারবি?
ওয়ার্কশপের কোণে রাখা পুরানো ওয়াশিং মেশিনটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। আগের দিন কিনে এনেছেন ওটা রাশেদ চাচা। এককালে বোধহয় সাদা রঙ ছিল, এখন হলদে হয়ে গেছে, জাগায় জায়গায় চলটা ওঠা। জায়গায় জায়গায় বাকাচোরা, টেপ খাওয়া। কিশোরের মনে হলো, দোমড়নো কাগজ হাত দিয়ে চেপেচুপে আবার সোজা করা হয়েছে। মোটরটার অবস্থা কি হবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে। বলল, চেষ্টা করে দেখতে পারি। সারা দিন লাগত।
চাচী হাসলেন। দুশ্চিন্তা অনেকটা দূর হলো। কিশোরের চেষ্টা করা মানেই তিনি ধরে নিলেন, হয়ে গেছে। নগদ পয়সা দিয়ে একটা জিনিস কিনে এনে বিক্রি হবে না, এ-দুঃখ কি সওয়া যায়? অন্তত মেরিচাচীর জন্যে এটা রীতিমত মনঃকষ্টের ব্যাপার।