স্টিয়ারিং এখনও জানেই চেপে রেখেছে টিনহা! ঘষা খেয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে টায়ার। জোর ঘষা লাগছে জানালার সঙ্গে দেয়ালের! খামচে টেনে জানালার চামড়া ছিড়ে রাখতে চাইছে রুক্ষ পাথরের দেয়াল।
স্টিয়ারিং সোজা করল টিনহা। দেয়ালের সঙ্গে একপাশের পুরো বডির ঘষা লাগছে এখন। চাকা জ্যাম হয়ে গেল। পিছলে আরও দশ গজ মত সামনে বাড়ল গাড়ি, প্রচণ্ড ঝাকুনি দিয়ে থেমে গেল। বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন।
পুরো এক মিনিট কেউ কোন কথা বলতে পারল না। স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে টিনহা, জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে।
ও-কে, মাথা তুলল টিনহা কণ্ঠস্বর খসখসে, কিন্তু সামলে নিয়েছে অসাধারণ স্নায়ুর জোর। চলো, নামি। দেখি, ক্ষতি কতখানি হয়েছে। রবিন, তোমার দিক দিয়ে বেরোতে হবে, এদিকে দরজা আটকে গেছে! – নামল তিনজনে। রবিনের গায়ের কাঁপুনি থামেনি। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে পঁড়িয়ে থাকল আরও কিছুক্ষণ। মনে পড়ল মুসার কথা।
ঝট করে সোজা হলো রবিন, তাড়াতাড়ি গিয়ে পেছনের টেইলগেট নামিয়ে উকি দিল। চেঁচিয়ে ডাকল, কিশোর, দেখে যাও।
ছুটে এল কিশোর। দুজনে উঠে পড়ল ট্রাকের পেছনে।
হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে মুসা। নিথর। তাড়াতাড়ি তার হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল রবিন।
নড়েচড়ে উঠল মুসা। চোখ মেলল। ফিসফিস করে বলল, আল্লাহরে।…বেঁচে আছি না মরে গেছি…
বেঁচেই আছ, এত উত্তেজনার মাঝেও মুসার কথার ধরনে না হেসে পারল না রবিন, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বন্ধুকে নিরাপদ দেখে। পালস ঠিক আছে, কপার ভঙ্গিও আগের মতই।
কে বলল আগের মত? উঠে বসে হাত-পা ভেঙেছে কিনা টিপেটুপে দেখল সা। গলার ভেতরে কোলাব্যাঙ ঢুকেছে বুঝতে পারছ না?…কিন্তু হয়েছিল কি? ঠাটা পড়েছিল? নাকি দৌড়ের বাজি লাগিয়েছিল।
মাথা নাড়ল কিশোর। আমার মনে হয় ব্রেকের সংযোগ কেটে দিয়েছে কেউ।
ইচ্ছে করে উঠে দাঁড়াল মুসা।
চলো, গিয়ে দেখি, বলল রবিন!
কিশোরের অনুমান ঠিক, বোঝা গেল। ওরা ট্রাকের পেছন থেকে নেমে এসে দেখল, বনেট তুলে ভেতরে দেখছে টিনহা। ব্রেক প্যাডালের কানেকশন রডটা কাটা, হ্যাণ্ডৱেকের সংযোগও বিচ্ছিন্ন। করাত দিয়ে নিখুতভাবে কাটা হয়েছে।
উলফের বাড়ির বাইরে যখন ছিল, তখন কেটেছে, কিশোর বলল। অনেকক্ষণ সময় পেয়েছে কাটার।
কে কাটল? ভুরু কোঁচকাল টিনহা। কেন?
কিশোরও জানে না এই প্রশ্নের জবাব। এ-নিয়ে ভাবতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়।
পরের দুঘন্টায় অনেক কাজ করতে হলো। একটা টেলিফোন বুদে গিয়ে ওশন ওয়ারম্ভে ফোন করল টিনহা। ক্রেন নিয়ে এল তার দুই মেকসিকান বন্ধু। সাদা পিকআপটাকে টেনে নিয়ে চলল ওরা। তিন গোয়েন্দাকে গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিল ইয়ার্ডে।
সোজা এসে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল কিশোর। সুইভেল চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। পুরোপুরি চালু করে দিল মগজ।
কে, শব্দ করে ভাবছে কিশোর, যাতে তার ভাবনায় সাহায্য করতে পারে রবিন আর মুসা, কেউ একজন চাইছে না, আমরা ক্যাপটেন শ্যাটানোগার বোটটা খুঁজে বের করি। আজ আমাদের খুন করতে চেয়েছিল সে-ই, কিংবা মারাত্মক আহত, টিনহাকে ঠেকাতে চেয়েছিল। ঠেকাতে চেয়েছিল আমাদের সবাইকেই, যাতে রোভারকে ট্রেনিং দিয়ে বোর্টটা খুঁজতে না পারি। থামল সে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল, তারপর বলল, তিনজন এখন আমাদের সন্দেহভাজন, চিনি, এমন তিনজন। এক, এক আঙুল তুলল সে, বিংগো উলফ। কিন্তু বোটটা খুঁজে পেলেই তার লাভ বেশি। সে-ই তো সব করেছে, টিনহাকে ফোন করেছে, তিমিটাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেছে, তার বাড়িতে পুলে জায়গা দিয়েছে, ওটাকে ট্রেনিং দেয়াতে বাধ্য করেছে টিনহাকে। এ সবই প্রমাণ করে, আমাদের সাফল্য চায় সে।
আবার থামল কিশোর। দুই আঙুল তুলল। দুই নম্বর, নীল বনেট।.ওর সম্পর্কে কি জানি আমরা? বলতে গেলে কিছুই না। আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে সে। আমাদের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার আগে থেকেই জানে আমাদের নাম, আমরা কে? কি করে জানল?
কেউ জবাব দিল না।
অনেক মিছে কথা বলেছে সে আমাদের সঙ্গে, টিনহার বাবা সেজেছে, আবার বলে চলল কিশোর। তবে কিছু সত্যি কথাও বলেছে। বলেছে, ক্যাপটেন শ্যাটানোগার সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিল উলফ, সে-সময় ঝড়ে ক্যাপটেনের বোট ডুবেছে মেকসিকোতে যাওয়ার সময়, না না, দড়াও, হাত তুলল সে, ভুল বলেছি। বাজা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফেরার সময়।
চুপ করে রইল দুই সহকারী।
নিথর হয়ে বসে রইল কিশোর কয়েক মুহুর্ত, তারপর হাত বাড়িয়ে টেনে নিল টেলিফোন। ডায়াল করল।
হ্যালো, স্পীকারে বেজে উঠল টিনহার কণ্ঠ।
আমি কিশোর।
ও, কিশোর। ভাল আছো? উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
না, উদ্বিগ্ন নই, জবাব দিল কিশোর। বিস্মিত।
বিস্মিত! কেন?
কয়েকটা কথা জানা দরকার। হয়ত সাহায্য করতে পারবেন।
বলো।
ওশন ওয়ারন্ডে আপনাকে আমাদের একটা কার্ড দিয়েছিলাম মনে আছে? কাউকে দেখিয়েছেন?
না।
কার্ডটা কি করেছেন?
ডেস্কের ওপরই ফেলে রেখেছিলাম।
অন্য কেউ দেখে ফেলতে পারে?
পারে। আরও কয়েকজন ট্রেনার বসে ওঘরে। দরজার তাল্য প্রায় সব সময়েই ভোলা থাকে। তোমরা সেদিন চলে যাওয়ার পর কার্ডটা রেখে তাড়াতাড়ি…
…চলে গিয়েছিলেন রোভারের কাছে, ও ভাল আছে কিনা দেখতে।