দেখাচ্ছে ভালই, মুসাকে বলল টিনহা। কিশোর, তোমার যন্ত্রটা কাজে লাগাও।
পুলের অন্য প্রান্তে ভাসছে রোভার। ওখানেই থাকতে শিখিয়েছে টিনহা, না ডাকলে আর কাছে আসবে না।
দেখি, দাও আমার কাছে, কিশোরের হাত থেকে রেকর্ডারটা নিল টিনহা। রেকর্ডিং সুইচ টিপে দিল।কোমরে একটা ওয়েটকেট পরে নিয়ে ডাইভ দিয়ে পড়ল পুলে। ইঙ্গিত পেয়ে রোভারও ডাইভ দিয়ে চলে গেল পুলের তলায়।
তাজ্জব হয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দা। টিনহা ডুব দিয়েছে তত দিয়েছেই, ওঠার নাম নেই। এতক্ষণ দম রাখছে কি করে? পরিষ্কার পানিতে দেখা যাচ্ছে তিমির মুখের কাছে যন্ত্রটা ধরে রেখেছে টিনহা, আরেক হাতের আঙুল নাড়ছে, মাঝেমধ্যে মটকাচ্ছে-দেখেই অনুমান করা যায়।
প্রায় দুই মিনিট পর ভেসে উঠল টিনহা। আস্তে আস্তে দম নিচ্ছে, ছাড়ছে, তাড়াহুড়ো করছে না। ফুসফুসকে শান্ত করে হাসল। ডেকে বলল, রেকর্ড করেছি। শোনা যাক, কেমন উঠেছে।
টেপটা শুরুতে গুটিয়ে নিল কিশোর, তারপর প্লে করল। প্রথমে ঢেউয়ের মৃদু ছলাতছল ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তারপর কয়েকটা মটমট, টিনহার আঙুল ফুটানোর আওয়াজ।
তারপর স্পীকারে স্পষ্ট ভেসে এল পাখির কাকলীর মত শব্দ, একবার উঁচু পর্দায় উঠেছে, আবার নামছে, সঙ্গে করতালি দিয়ে সঙ্গত করা হচ্ছে যেন।
হাতহালি বাদ দিলে একেবারে পাখি, ডাবল কিশোর। তবে অনেক বেশি জোরাল, গভীর, কম্পন সৃষ্টি করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এ-জাতীয় শব্দ আগে কখনও শোনেনি সে, ডাঙার কোন কিছুর সঙ্গেই পুরোপুরি তুলনা করা যায় না।
রোভার? ফিসফিস করে বলল রবিন, জোরে বললে ধেন আবেশ নষ্ট হবে। বোডারের গান?
গান বলো, কথা বলো, যা খুশি বলতে পারো, বলল টিনহা। এরকম শব্দ করেই ভাব প্রকাশ করে তিমি। তিমির ভাষা বোঝা সম্ভব হয়নি। হলে হয়তো দেখাযাবে, আমাদের কথার মতই অর্থবহ, জটিল ওদের কথাও।
ফ্লিপার খুলে নিল টিনহা। তবে মানুষের মত ঝগড়া করে না ওরা, লড়াই করে না। মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য। মিথ্যেও বলে না নিশ্চয়। কথা বলেই বা কি লাভ, যদি সেটাকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে খালি খারাপের দিকে নিয়ে যাই
আবার শুনি? মূসা অনুরোধ করল।
দাঁড়াও, আগে রোভারকে শুনিয়ে নিই।
টেপটা আবার শুরুতে এনে প্লে টিপে যন্ত্রটটিনহার হাতে দিল কিশোর। পুলের কিনারে ঝুঁকে বাক্সটা পানির তলায় নিয়ে গেল টিনহা। রোভারকে লক্ষ করছে তিন গোয়েন্দা।
আরাম করে শুয়ে আছে পলের তলায় রোভার। হঠাৎ শিহরণ খেলে গেল বিশাল শরীরটায়। শরীরের দুপাশে টান টান হয়ে গেল পাখনাগুলো। শাঁ করে এক ছুটে চলে এল পুলের এপাশে। রবিনের মনে হলে হাসছে তিমিটা, প্রথমদিন যেমন করে হেসেছিল, তেমনি।
কাছে এসে থামল রোভার। এক মুহুর্ত দ্বিধা করে ঠোঁট ছোয়াল বাক্সের গায়ে।
ও-কে, গুড, কক্সটা পানি থেকে তুলল টিনহা। লক্ষ্মী রোভার, লক্ষ্মী ছেলে। সন্তুষ্ট হতেছে। একটা মাছ উপহার দিল।
পানি থেকে লাফিয়ে উঠে শুন্যেই খপ করে মাছটা ধরল রোভার, ঝপাত কর, পড়ল আবার পানিতে।
এটাই দেখতে চেয়েছিলাম, বাক্সের দিকে ইঙ্গিত করে বলল টিনহা। মনে হচ্ছে কাজ হবে। সাগরে ছাড়লে দূরে চলে গেলেও এর সাহায্যে ডেকে আনতে পারব। ওর ডাকই একে ফিরিয়ে আনবে।
আরেকটা ক্যাসেটে রি-রেকর্ড করে দিতে পারি, কিশোর পরামর্শ দিল। এটাকে বার বার প্লে করে অন্য ক্যাসেটে রেকর্ড করতে থাকব, এখানে আছে দেড়দুই মিনিট, আধ ঘণ্টা বানিয়ে ফেলতে পারব এটাকে।
মন্দ বুদ্ধি না, বাক্সটা বাড়িয়ে দিল টিনহা। হাসপাতালে যাওয়া দরকার। চলো, তোমাদেরকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাই।
র্যঞ্চ হাউসের বাইরে পথের পাশে পার্ক করা আছে সাদা পিকআপ। আগের মতই এবারেও মুসা উঠল পেছনে, অন্য তিনজন সামনে।
খুব সতর্ক, দক্ষ ড্রাইভার টিনহা। কিন্তু এখন তার চালানো দেখে মনে হচ্ছে, কেমন যেন বেসামাল। মোড়ের কাছেও গতি কমাচ্ছে না, বেপরোয়া গতির রেকর্ড ভঙ্গ করতে চলেছে যেন।
সামনে ডান দিকে তীক্ষ্ণ একটা মোড়। লাগামছাড়া পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে যাচ্ছে গাড়ি।
হ্যাণ্ডব্রেক টানল টিনহা। কিছুই হলো না! গতি কমল না গাড়ির। ইমারজেন্সী ব্রেকটা পুরো চাপল। কিন্তু স্পীডোমিটারের কাটা তোয়াক্কাই করল না, দ্রুত সরে যাচ্ছে ডানে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ।
কি হয়েছে…, কথা আটকে যাচ্ছে রবিনের। ব্রেকে গোলমাল।
মাথা ঝাঁকাল টিনহা। কিছুতেই কাজ করাতে পারছি না। শীয়ারের হাতল চেপে ধরে টান দিল, ইঞ্জিন নিচু গীয়ারে এনে গতি কমাতে চাইছে। থরথর করে কাপছে গাড়ি। মিটারের কাঁটা অস্থির।
৮
পথের মাঝখানে গাড়ি নিয়ে এসেছে টিহা উল্টো দিক থেকে যদি কোন গাড়ি আসে এখন, মুখোমুখি সংঘর্ষে চুরমার হয়ে যাবে দুটোই।
সামনে গাড়ি দেখা গেল না। ভীষণ দৈত্য মনে হচ্ছে এখন সামনের মোড়ের পাথুরে পাহাড়ী দেয়ালটাকে!
ড্যাশবোর্ডে পা, আর সীটের পেছনে পিঠের চাপ দিয়ে শরীরটাকে কঠিন করে তুলেছে কিশোর আর রবিন। ধাক্কা প্রতিরোধের জন্যে তৈরি কতখানি ঠেকাতে পারবে, আদৌ পারবে কিনা, জানে না।
শাঁই করে ভানে স্টিয়ারিং কার্ট টিনহা, একই সঙ্গে রিভার্স করে দিল গীয়ার এখনও দেয়ালটা চটে আসছে মানে হচ্ছে।
চোখের পলকে ঘটে গেল অনেকগুলো ঘটনা, একটা স্ফুলিঙ্গ ছুটতে যতখানি সময় লাগে, ততটুকু সময়ের মধ্যে; হঠাৎ যেন এক পাশে সরে গেল দেয়াল, পরক্ষণেই পাশের জানালার কয়েক ইঞ্চি তফাতে চলে এল। গো গো চিৎকারে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে ইঞ্জিন। সীট খামচে ধরেছে কিশোর আর রবিন। কাজগুলো করছে অনেকটা অবচেতন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আসলে তাদেরকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে তাদের মগজ।