- বইয়ের নামঃ হারানো তিমি
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
হারানো তিমি
১
ওই যে, তিমির ফোয়ারা! চেঁচিয়ে উঠল উত্তেজিত রবিন। আরে দেখছ না, ওই যে…ওইই, সাগরের দিকে হাত তুলে দেখাল সে।
এইবার দেখল মুসা। ঠিকই। তীর থেকে মাইল তিন-চার দূরে ভেসে উঠেছে যেন ছোটখাট এক দ্বীপ, পানির ফোয়ারা ছিটাচ্ছে। মিনিটখানেক এদিকওদিক পানি ছিটিয়ে ডুবে গেল আবার ধূসর মস্ত জীবটা।
সৈকতের ধারে উঁচু পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা ও কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড। আবার এসেছে বসন্ত, স্কুল ছুটি। এই ছুটিতে তিমির ওপর গবেষণা চালাবে ওরা, ঠিক করেছে। খুব ভোরে তাই সাইকেল নিয়ে ছুটে এসেছে সাগর পারে, তিমির যাওয়া দেখার জন্যে।
প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারির এই সময়ে আলাসকা আর মেকসিকো থেকে আসে তিমিরা, হাজারে হাজারে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ধরে চলে যায়, যাওয়ার পথে থামে একবার বাজা ক্যালিফোর্নিয়ায়। মেয়েরা বাচ্চা দেয় ল্যাগুনের উষ্ণ পানিতে, পুরুষেরা বিশ্রাম নেয়।
কয়েক হপ্তা পর বাচ্চারা একটু বড় হলে আবার বেরিয়ে পড়ে ওরা। এবার আর থামাথামি নেই, একটানা চলা। প্রায় পাঁচ হাজার মাইল সাগরপথ পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছায় উত্তর মেরুসাগরে। গরমের সময় ওখানকার পানি ছেয়ে থাকে খুদে চিঙড়ি আর প্ল্যাঙ্কটনে, ধূসর তিমির প্রিয় খাবার।
যাওয়ার সময় সবাই দেখে ওদেরকে, বলল রবিন, কিন্তু ফেরার সময় দেখে। আগের দিন রকি বীচ লাইব্রেরিতে তিমির ওপর পড়াশোনা করে কাটিয়েছে সে। যা যা গিলেছে সেগুলো উগড়াচ্ছে এখন।
কেন? জানতে চাইল মুসা।
ফেরার পথে হদিস রাখা যায় না বোধহয়, হাতের খোলা নোটবুকের দিকে তাকাল আরেকবার রবিন। যাওয়ার সময় দল বেঁধে যায় ওরা, সবার চোখে পড়ে। ফেরার পথে বড় একটা পড়ে না, হয়তো একা একা ফেরে বলে। কারও কারও মতে ফেরে একা নয়, জোড়ায় জোড়ায়। তাহলেও বিশাল সাগরে দুটো তিমির পেছনে কে কতক্ষণ লেগে থাকতে পারবে? পথ তো কম নয়, হাজার হাজার মাইলের ধাক্কা।
তা ঠিক, সায় দিল মূসা। কিশোর, তোমার কি মনে হয়? কিন্তু ওদের কথায় কান নেই গোয়েন্দাপ্রধানের। দূরে সাগরের যেখানে তিমির ফোয়ারা দেখা গেছে, সেদিকেও চোখ নেই। সে তাকিয়ে আছে নিচের নির্জন সৈকতের একটা অগভীর খাঁড়ির দিকে। আগের দিন রাতে ঝড় হয়েছিল, ঢেউ নানারকম জঞ্জাল-ভাসমান কাঠের গুড়ি, প্ল্যাসটিকের টুকরো, খাবারের খালি টিন, উপড়ানো আগাছা, শেওলা, আরও নানারকম টুকিটাকি জিনিস এনে ফেলেছে খাঁড়িতে।
কি যেন একটা নড়ছে, বলে উঠল কিশোর। চলো তো, দেখি। কারও জবাবের অপেক্ষা না করেই ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল সে। তাকে অনুসরণ করল অন্য দুজন।
ভাটা শুরু হয়েছে, ইতিমধ্যেই অর্ধেক নেমে গেছে পানি। খাঁড়ির কাছে এসে থামল কিশোর, আঙুল তুলে দেখাল।
আরে তিমি! মুসা বলল। মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আটকে গেছে। সাহায্য না পেলে মরবে।
তাড়াতাড়ি জুতো-মোজা খুলে নিল তিনজনে। শুকনো বালিতে রেখে, প্যান্ট গুটিয়ে এসে নামল কাদাপানিতে।
ছোট্ট একটা তিমি, মাত্র ফুট সাতেক লম্বা। বাচ্চা তো, তাই এত ছোট-ভাবল রবিন। ঝড়ের সময় কোনভাবে মায়ের কাছছাড়া হয়ে পড়েছিল, ঢেউয়ের ধাক্কায় এসে আটকা পড়েছে চরায়।
সৈকত এখানে বেশ ঢালু, ফলে খুব দ্রুত নামছে পানি। ওরা তিমিটার কাছে আসতে আসতেই গোড়ালি পর্যন্ত নেমে গেল পানি এতে সুবিধেই হলো ওদের। বেশি পানি হলে অসুবিধে হত, ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে, বরফ-শীতল পানি। তবে পানি কমে যাওয়ায় বাচ্চাটা পড়ল বিপদে, সাগরে নামতে পারছে না।
তিনজনে মিলে গায়ের জোরে ঠেলা-ধাক্কা দিল, কিন্তু নড়াতে পারল না ওটাকে। হাজার হোক তিমির বাচ্চা তো, যত ছোটই হোক, মানুষের জন্যে বেজায় ভারি। তিরিশ মণের কম না, ভাবল কিশোর। বান মাছের মত পিচ্ছিল শরীর, হাত পিছলে যায়। তার ওপর না ধরা যাচ্ছে পাখনা, না লেজ, কিছু ধরে টেনেটুনে যে সরাবে তারও উপায় নেই। বেশি জোরে টানাটানি করতেও ভয় পাচ্ছে, কি জানি কোথাও যদি আবার ব্যথা পায় তিমির বাচ্চা।
ওদের মোটেও ভয় পাচ্ছে না বাচ্চাটা, যেন বুঝতে পেরেছে, ওকে সাহায্য করারই চেষ্টা হচ্ছে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে ওদেরকে। কথা বলতে পারলে বুঝি বলেই উঠত মারো জোয়ান হেঁইও, জোরসে মারো হেঁইও। .
রবিন এসে দাঁড়াল মাথার কাছে। বিশাল মাথা ধরে ঠেলার চেষ্টা করতে গিয়েই খেয়াল করল, ফোয়ারার ছিদ্রটা অন্যরকম। ভুল ভেবেছে এতক্ষণ। বাচ্চা তিমি না এটা।
কিশোর আর মুসাকে কথাটা বলতে যাবে, এই সময় বিশাল এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল, এক ধাক্কায় চিত করে ফেলল ওদেরকে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে আবার খাড়া হলো ওরা, ততক্ষণে চলে গেছে পানি। ঢেউ আসার আগে গোড়ালি অবধি ছিল, সেটা কমে গিয়ে হয়েছে বুড়ো আঙুল সমান। খাঁড়ি থেকে উঠে তিমিটা গিয়ে আরও খারাপ জায়গায় আটকেছে, সৈকতের বালিতে। খাঁড়িতে যা হোক কিছু পানি আছে, ওখানে তা-ও নেই।
মরছে, বলে উঠল মুসা। এবার আরও ভালমত আটকাল। জোয়ার আসতে আসতে কর্ম খতম।