চুপ। কার সঙ্গে তুলনা। কোথায় ভদ্রলোকের বাচ্চা, আর কোথায় চোরা ম্যাকআরবারের মুরগীচোর।
কুকুর ভদ্রলোকের বাচ্চা হয় কি করে? ফস করে জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভদ্রলোকের না হোক ভদ্ৰকুকুরের তো?
তা বলতে পারো…
আরে কি বকবক শুরু করলে তোমরা? বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর, গভীর মনযোগে খনি আর তার আশপাশের অঞ্চল দেখছিল। জিনা, নামো, পথ দেখাও।
খনিমুখের ভেতরে ঢুকে টর্চ জ্বালল জিনা। চালু হয়ে নিচে নেমে গেছে সুড়ঙ্গ। দুপাশের দেয়াল ঘেঁষে পোতা হয়েছে রেললাইনের সীপারের মত বড় বড় মজবুত তক্তা, তার ওপর বীম লাগিয়ে পাথুরে ছাত সহজে যাতে ধসে না পড়ে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সুড়ঙ্গের ভেতরে স্তব্ধ নীরবতা। সব কিছু শান্ত, তবু পরিবেশটা এমন, অকারণেই গা ছমছম করে।
খুব ধীরে ধীরে অমসৃণ ঢাল রেয়ে নামতে শুরু করল ওরা।
পর্বতের ভেতরে পঞ্চাশ গজমত ঢুকে দূ-ভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ, একটা সোজা এগিয়েছে, আরেকটা বায়ে সামান্য মোড় নিয়েছে। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বায়ের পথটাই ধরল জিনা। তাকে অনুসরণ করল ছেলেরা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে যে আবছা আলো আসছিল এতক্ষণ, মোড় নেয়ায় সেটাও হারিয়ে গেল।
পাথুরে মেঝেতে নিজেদের জুতোর শব্দই কেমন যেন ভুতুড়ে শোনাচ্ছে।
মহিলা পড়েছিল যেন কোথায়? নিচু গলায় বলল জিনা। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
জিনা, দাঁড়াও, হাত তুলল কিশোর। সামনে মেঝেতে কিছু একটা চোখে পড়েছে। এই যে, এদিকে, আলো ফেরাও?
আলো ফেলল জিনা। আলগা পাথর, নুড়ির ছোট একটা স্কুপ। দেয়াল আর হাত থেকে খসে পড়ে জমা হয়েছে বোধহয়।
এগিয়ে গিয়ে তুলে নেয়ার জন্যে ঝুঁকল কিশোর, এই সময় আলো সরে গেল।
আরে আরে, যাচ্ছ কোথায়? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। টর্চটা…এই জিনা?
কিন্তু জিনা থামল না। টর্চের আলো নাচতে নাচতে সরে যাচ্ছে দূরে। পাশের একটা করিডরে ঢুকে গেল সে।
জিনা! চেঁচিয়ে ডাকল রবিন।
হঠাৎ পেছনে আলো দেখা গেল, উজ্জ্বল আলো যেন নগ্ন করে দিল তাদেরকে! বুঝল, হঠাৎ কেন ছুটে পালিয়েছে জিনা।
এই এই, কি করছ ওখানে? ম্যাকআরথারের কড়া গলা।
মরেছি! ফিরে তাকানোর সাহস হচ্ছে না মুসার।
জিনার হাত থেকে টর্চ খসে পড়ার শব্দ হলো। ঝনঝন করে উঠল পাথরে বাড়ি খেয়ে, কাচ ভাঙল।
অন্ধকার করিডরের শেষ মাথা থেকে ভেসে এল জিনার রহিম-করা চিৎকার।
চেঁচিয়েই চলল সে, একনাগাড়ে।
৬
জিনা? কি হয়েছে, জিনা? ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
জবাবে শুধুই চিৎকার। মাথা খারাপ হয়ে গেছে যেন জিনার।
মরছে নাকি! আলো হাতে পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল ম্যাকআরখার, করিডরে গিয়ে ঢুকল।
পেছনে গেল ছেলেরা।
মস্ত এক কালো খাদের পাড়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে জিনা। আরেক পা এগোলেই যেত পড়ে গর্তের মধ্যে।
থামো! এই মেয়ে, শুনছ? চুপ! ধমক দিল ম্যাকআরথার। হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে জিনাকে সরিয়ে আনল গর্তের ধার থেকে। কি, হয়েছে কি?
থরথর করে কাঁপছে জিনা, হাত তুলে ইঙ্গিত করল গর্তের দিকে। ও-ওখানে…নিচে…
সাবধানে খাদের পাড়ে এসে দাঁড়াল চারজনে। ভেতরে আলো ফেলল ম্যাকআরখার, উঁকি দিল ছেলেরা। বেশি গভীর নয়, দশ-বারো ফুট। তবে একেবারে খাড়া দেয়াল।
খাদের তলায় কি যেন পড়ে আছে। প্রথমে কাপড়ের স্তুপ বলে মনে হলো। কিন্তু ঠিকমত আলো ফেলে ভাল করে তাকাতেই দেখা গেল, একটা হাত বেরিয়ে আছে। কাপড়ের ভেতরে রয়েছে দেহটা, দুমড়ে-মুচড়ে বিকৃত। চোখের জায়গায়। দুটো শূন্য কোটর, মাথার চুল পাটের রুক্ষ আঁশের মত লেপটে রয়েছে খুলির সঙ্গে।
মরা! চেঁচিয়ে উঠল আবার জিনা। মরা!…মরে গেছে।
আহ, থামোতো। আবার ধমক লাগাল ম্যাকআরথার।
ঢোক গিলল জিনা, চুপ করল।
বেরোও, আদেশ দিল ম্যাকআরথার। সব্বাই।
দু-পাশ থেকে জিনার দু-হাত ধরে টেনে নিয়ে এগোেল কিশোর আর রবিন। পেছনে টলমল পায়ে চলল মুসা। সবার পেছনে আলো হাতে রয়েছে। ম্যাকআরথার।
খোলা আকাশের নিচে উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল ওরা।
কুকুরের পরিচিত ডাক অপার্থিব লাগছে কিশোরের কানে। যেন এইমাত্র ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে। গুহার তলায় কাপড়ের স্তুপের ভেতরে কোচকানো চামড়া আর হাড্ডি সর্বস্ব হাত, শূন্য কোটর, লেপটানো চুল…শিউরে উঠল সে, কড়া রোদের মাঝেও শীত শীত লাগছে।
যাও, বাড়ি যাও, বলল ম্যাকআরথার। খবরদার, আর কখনও এদিকে আসবে না। যদি আর কোনদিন দেখি…
গটমট করে গিয়ে কেবিনে ঢুকল সে, দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা।
ধীর পায়ে এগোল ছেলেরা। খনিমুখের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখন একটা উজ্জা লাল শেভি সুবারব্যান ট্রাক, ম্যাকআরথারের। ওটার পাশ দিয়ে মাঠ পেরিয়ে এগোল। পিকআপের পাশ কাটিয়ে এল, চালানোর সাধ্য নেই আর এখন জিনার। হেঁটে চলল বাড়িতে।
র্যাঞ্চ হাউসে ফিরতে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল জিনা। রক্ত ফিরল মুখে। শেরিফকে খরব দিতে হবে। ম্যাকআরথারের কাজ। আগেই বলেছি, বাটা নাম্বার ওয়ান শয়তান।
তোমার দরকার নেই, বলল কিশোর, সেই এতক্ষণে খবর দিয়ে ফেলেছে। শেরিফকে। শেরিফের কাছে ওর কথা উল্টো-পাল্টা কিছু বলবে না, সাবধান।
কেন বলব না? তর্ক শুরু করল জিনা। ওর খনিতে মানুষ মরে পড়ে আছে…
শহরের দিক থেকে ছুটে আসছে ছোট্ট একটা ধুলোর মেঘ। কয়েক সেকেন্ড পর ওদের পাশ কাটিয়ে গেল মেঘটা, বাদামী রঙের একটা সিডান গাড়ি। দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ওশেরিফ। পলকের জন্যে ড্রাইভারকে দেখতে পেল ছেলেরা, বিশালদেহী লোক, মাথায় স্টেটসন হ্যাট! ম্যাকআরথারের কেবিনের সামনে গিয়ে থামল গাড়ি।