জানালার কাচের পর্দা সরিয়ে পাল্লা খুলে দিলেন মিস কারমাইকেল। একে একে বেরিয়ে এল ছেলেরা মহাকোলাহলের মধ্যে। একবার ফিরে তাকাল কিশোর, তাদের দিকে নজর নেই মহিলার। হাতের মুক্তোটা দেখছেন, মুখে হাসি।
ড্রাইভওয়ে ধরে সাইকেল চালিয়ে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা। এখানে কথা বলার চেষ্টা বৃথা। দূরে গিয়ে তারপর যা বলার বলবে, ভাবল কিশোর। পাখির কলরব কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে, অসহ্য লাগছে তার।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ চিৎকারে থেমে গেল কিশোর। প্রথমে ভেবে ছিল পাখির ডাক, কি ভেবে ফিরে তাকাল বাড়ির দিকে। পাখি নয়, বাজ পাখির গলা নকল করে চেঁচিয়ে উঠেছেন মিস কারমাইকেল, কিশোর ফিরে তাকাতেই হাত তুলে ডাকলেন।
আমার এক বন্ধু আছে, গাইলেন মিস কারমাইকেল, রিচার্ড হ্যারিস নামটি তাহার, বাস করে এই শহরেই; পায়রা পোষার শখ ছিল তার, বলেছে সে একদিন। কি আফসোস, ভুলেই ছিলাম, কি আফসোস, ভুলেই ছিলাম।
ব্যাংকিউ, মিস কারমাইকেল, বলল কিশোর। রিচার্ড হ্যারিস নামটি আমি আর সহজে ভুলব না, শেষের কথাগুলো সুর করে বলল।
৪
রিচার্ড হ্যারিস, মিউজিক নেস্ট থেকে দূরে মহাসড়কের শান্ত পরিবেশে ফিরে এসে বন্ধুদেরকে বলল কিশোর, মেইন স্ট্রীটের একটা অলঙ্কারের দোকানের নাম।
পথের ধারে ঘাসের ওপর সাইকেল নিয়ে এল সে, সাইকেল থেকে নামল। রবিন আর মুসাও নামল।
শোনো, মুসা প্রস্তাব দিল, এত সব ঝুট ঝামেলা না করে চলো আবার মিস, কারমাইকেলের বাড়িতে ফিরে যাই। তার সামনে খাঁচা থেকে ছেড়ে দিই টমকে। কুড়ি ডলার নিয়ে ফিরে আসব। ছাড়া পেলেই বাড়ি ফিরে যাবে টম, তার বন্ধুদের কাছে। আমাদেরও ঝামেলা শেষ।
এই আশঙ্কাই করছিল কিশোর। তবে একেবারে মন্দ বলেনি মুসা, অন্তত পাখিটার পক্ষ থেকে ভাবলে সেটা করাই ভাল। কেন খাঁচায় বন্দি রেখে কষ্ট দেয়া? ছাড়া পেলে নিজের ঝাঁকে বন্ধুদের মাঝে ফিরে যেতে পারবো।
কিন্তু এই পায়রাটাই এখন একমাত্র সূত্র রহস্যভেদী কিশোর পাশার কাছে, হাতছাড়া করতে সায় দিচ্ছে না তার মন। চমৎকার একটা রহস্য দানা বেঁধে উঠেছে, শুরুতেই দেবে সব ভণ্ডুল করে, এটা ভাবতে পারছে না।
হেডকোয়ার্টারে চালু করে দিয়ে আসা জবাব দেয়ার যন্ত্রটার কথা ভাবল কিশোর। সবুজ গাড়িওয়ালা লোকটা আগের কবুতরটাকে চুরি করে থাকলে, আর সেটা স্লেটারের জানা না থাকলে শিগগিরই ফোন করবে। দু-আঙলাকে ফেরত চাইবে। নিতে আসবে। তখন তার সামনে থাকতে চায় কিশোর। দেখতে চায়, তিন-আঙলাকে দেখে কি প্রতিক্রিয়া হয় সুেটারের। চিনতে পারে কিনা কবুতরটাকে।
এখুনি ছেড়ে না দিয়ে, বলল কিশোর, আগে রিচার্ড হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করে নিই। যাওয়ার সময় পথেই পড়বে তার দোকান। রবিন, তুমি কি বলে?
ঠিক আছে,অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল মুসা, তোমরা যখন চাও:হ্যালো, মিটার রিচার্ড হ্যারিস, আসিতেছি আমরা।
রকি বীচের সব চেয়ে দামী অলঙ্কারের দোকান রিচার্ড হ্যারিস-মালিকের নামে নাম। খরিদ্দার আকৃষ্ট করার জন্যে বাইরের শো-কেসে ঘুড়ি কিংবা আঙটির। মত শস্তা জিনিস নেই। আছে কুচকুচে কালো মখমলে মোড়া ধাতব স্ট্যাওে ঝোলানো মুক্তার অনেক দামী, একটা হার, আর সেটার দুপাশে বেশ কায়দা করে আটকানো হীরের দুটো ব্রৌচ। উজ্জল দিবালোকে ঝলমল করে জ্বলছে, য়েন, নীরবে ঘোষণা করছে আমাদের দেখেই অবাক হয়ে গেলেন? ভেতরে এসে দেখুন না, আরও কত কি আছে।
ভেতরে অনেকগুলো কাচের বাক্স সাজানো। ভেতরে দামী দামী সব গহনা।
বড় একটা বাক্সের ওপাশে দাঁড়ানো একজন লোক। বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা শরীর, গায়ে কালো কোট, পরনে কড়া ইস্তিরী করা ডোরাকাটা প্যান্ট। সিঙ্কের টাই আর শক্ত মাড় দেয়া কারও মনে হচ্ছে আছে পরনে, তবে সেটা দেখা যায় না দাড়ির জন্যে। লম্বা কালো দাড়ি মুখের পুরোটাই প্রায় ঢেকে দিয়েছে, শুধু নাক আর চোখ দেখা যাচ্ছে। ঘন জঙ্গলের মাঝে খোলা জায়গার মত ঠোঁট দেখা যায়, তবে অস্পষ্ট।
বলো? তিন গোয়েন্দাকে কতে দেখে প্রশ্ন করল লোকটা।
মিস্টার রিচার্ড হ্যারিস? জানতে চাইল কিশোর।
হ্যাঁ।
কিশোর জানাল, তারা মিস কোরিন কারমাইকেলের বন্ধু। মহিলার নাম নেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল হ্যারিসের চোখ।
বলে গেল কিশোর, কারমাইকেলের কাছেই মিস্টার হ্যারিসের নাম শুনেছে ওরা। একটা বেলজিয়ান রেসিং হোমার নিয়ে এনেছে। দেখে দয়া করে যদি মিস্টার হ্যারিস জানান কবুতরটা কার (যদি অবশ্য চিনতে পারেন) তো সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবে কিশোর, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরে না না, কে বলে আমি বিশারদ, বিনয়ে গলে গেল মিস্টার হ্যারিস। একবার কবুতর পোষার শখ হয়েছিল, চেষ্টা করেছিলাম। ভাল লাগেনি, ছেড়ে দিয়েছি। সে অনেক বছর আগের কথা। মুসার হাতের খাঁচার দিকে তাকাল। ওটাই নাকি?
হ্যাঁ, খাঁচাটা ওপরে তুলল মুসা, হ্যারিসকে ভালমত দেখানোর জন্যে।
মিনিটখানেক নীরবে পাখিটাকে দেখল হ্যারিস, জিজ্ঞেস করল, পেলে কোথায়? তোমাদের কাছে এল কি করে?
আমাদের বাড়িতে কে জানি ফেলে রেখে গেছে, সেটারের কথা চেপে গেল কিশোর।
কে?
জানি না, মুসা জবাব দিল। সকাল বেলা পেলাম। সে জন্যেই এসেছি আপনার কাছে। ভাবলাম, আপনি হয়তো জানেন…।
মাথা নাড়ল হ্যারিস। বেলজিয়ান রেসিং হোমার নয় এটা। মানে, হোমারই, তবে রেসার বলা চলে না। মেয়ে পাখি তো, রেস দেয় না।