অন্য দুজনও ঢুকল। পান্না ঠেলে লাগিয়ে আবার জায়গা মত খিলটা তুলে দিল মুসা। এবার কি? কিশোরের কানে মুখ ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
গাছপালার ভেতরে দিয়ে একেবেঁকে যাওয়া গাড়িচলা পথটা দেখাল কিশোর, সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করল।
এগিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। কলরং সামান্যতম নি, বরং বাড়ছে বলে মনে হলো ওদের। ওই প্রচণ্ড শব্দ বেশিক্ষণ আর সইতে পারত . বিন, হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দিয়ে দু-হাতে কান ঢাকল, শুধু পা আর কোমরের সাহায্যে ব্যালান্স করে সাইকেল চালাচ্ছে।
আগে আগে ছিল কিশোর, হঠাৎ থেমে গেল। গাছগাছালি আর পঙ্গপালের মত পাখির ঝাকের ফাঁক-ফোকর দিয়ে একটা বিশাল বাড়ির খানিকট চোখে পড়ছে। কিন্তু বাড়ি দেখে থমকায়নি সে, অন্য কারণ
পাখির কলকাকলী ভেদ করে কানে আসছে আরেকটা কণ্ঠ, মহিলা কণ্ঠের গান, তীক্ষ্ণ, উঁচু পর্দা, কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে না। নরম গলায় গাইলে আর এত
সব কোলাহল না থাকলে বেশ মিষ্টিই শোনাবে।
আরেকটু আগে বাড়ল ওরা।
আবার গান গাইল মহিলা, কথাগুলো বোঝা গেল এবার : তিনটে ছেলে ড্রাইভওয়েতে, কি চাই ওদের, কি চাই।
সুরটা পরিচিত মনে হলো রবিনের। ও, মনে পড়েছে দি ব্যাট হাইম অভ দা রিপাবলিক।
আসছে ওরা আরও কাছে, গেয়েই চলেছেন মহিলা, আসছে ওরা আসছে গো। ভয় পেয়ো না মিষ্টি পাখি, ভয় পেয়ো না লক্ষ্মীরা! হয়তো ওরা কোনই ক্ষতি করবে নাকো তোমাদের।
সাইকেল থেকে নেমে হ্যাণ্ডেল ধরে ঠেলে নিয়ে চলল তিন কিশোর।
গাছের জঙ্গল আর বাড়ির মাঝের ছড়ানো লনে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝবয়েসী মহিলা। সাধারণের চেয়ে বেশিই লম্বা! গরমকালের ঢেলা হালকা পোশক পরনে। মাথায় নরম হ্যাট, চওড়া কানা। গোলগাল বেশ সুন্দর চেহারা।
তার কাঁধে বসে আছে একটা তোতা, হ্যাটের চঁদিতে শুয়ে ঝিমাচ্ছে একটা ক্যানারি। আর ঠিক মাথার ওপরে শূন্যে ফড়ফড় করে ডানা ঝাপটাচ্ছে একটা বাজ, বসার সুবিধেমত জায়গা খুঁজছে।
কথা কিছু থাকলে বলার, বলে শুনি গান গেয়ে, তিন গোয়েন্দা একেবারে কাছে চলে এল বললেন মহিলা। দরাজ গলায় গাইবে গান, নইলে কানে ঢুকবে না, কিছুই কানে ঢুকবে না।
পাগলের পাল্লায় পড়েছে, কোন সন্দেহ নেই মুসার, জরুরী অবস্থায় পালানোর জন্যে তৈরি হয়ে রইল। রবিন,চুপ। বার বার তাকাচ্ছে কিশোরের দিকে।
কিশোর বুঝল, জবাব তাকেই দিতে হবে। খুব ভাল অভিনেতা সে, শিশুকালেই টেলিভিশনে অভিনয় করে অনেক সুনাম-কুড়িয়েছে, কিন্তু গানের ব্যাপারে সে আনাড়ি। কখনও গলা সেধে দেখেনি। এমনকি বাথরুমেও কখনও গুনগুন করেছে কিনা মনে পড়ে না। সমস্যায় পড়ে গেল। মনে মনে গুছিয়ে নিল শব্দগুলো কবিতার মত করে, তারপর হেঁড়ে গলায় গান ধরল? মিস কোরিনকে খুঁজি মোরা, পাখির যিনি বিশারদ; আপনি কি সেই…আপনি কি সেই…ইয়ে মানে… ইয়ে-তাল ছন্দ কথা সব হারিয়ে তোলাতে শুরু করল গোয়েন্দাপ্রধান।
হা-হা করে হেসে উঠেই রবিনের কনুইয়ের তো খেয়ে আঁউক করে থেমে গেল মুসা। বোধহয় শুনতে পাননি মহিলা, তাই ফিরে তাকালেন না। কিশোরের, কথার জবাব দিলেন আমিই সেই মিস কোরিন, খুঁজছ যাকে তোমরা।
আবার কিশোরের পালা। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল সে, অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল মিস কারমাইকেলের দিকে। সুর করে বলল, অনুপ্রবেশ করেছি বলে আমরা সবাই দুঃখিত। দি ব্যাটল হাইম অভ দ্য রিপাবলিক ঠিক রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু কোন ছিল না উপায়… থেমে গেল সে। না, কথা আটকে যায়নি, তার প্রতি মনোযোগ হারিয়েছেন মহিলা, চেয়ে রয়েছেন মুসার হাতের খাঁচাটার দিকে।
হাসলেন মিস কারমাইকেল, আন্তরিক হাসি, নেচে নেচে এগোলেন মুসার দিকে।
এক লাফে পিছিয়ে গেল মুসা। দ্রুত একবার তাকাল দু-পাশে। কোনদিকে দৌড় দিলে সুবিধে হবে আন্দাজ করল
কিন্তু দৌড় দিতে হলো না। তার আগেই গান গেয়ে উঠলেন মহিলা, সোনা আমার, লক্ষ্মী সোনা, কি চমৎকার দেখিতে টিটিরিংনা টিটিরিং টিটুটিরিংনা টিউটিরিং। বলেই কবুতরের গলা নকল করে বাগবাকুম করে উঠলেন।
ছোঁ মেরে মুসার হাত থেকে খাঁচাটা ছিনিয়ে নিলেন মিস কারমাইকেল। বুকে জড়িয়ে ধরে আবার গাইলেন, সেনা আমার, লক্ষ্মী সোনা, দেব ওদের পুরস্কার। টিউটিরিংনা টিউটিরিংনা…
৩
কি পুরস্কার… গেয়ে উঠে আবার থেমে গেল কিশোর, তার দিকে খেয়ালই নেই মহিলার, খাঁচার দরজা খুলছেন।
প্লীজ, চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, প্লীজ, খুলবেন না। তারপর যথাসম্ভব ভদ্রভাবে মিস কারমাইকেলের হাত থেকে নিয়ে নিল খাঁচাটা। বলল, মনে কিছু করবেন না, এটা আমাদের পায়রা না।
এরপর কি বলবে? মনে মনে ছন্দ সাজাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে গেল কিশোর। ব্যাখ্যা করে বোঝানো এক কথা, আর সেটা গান গেয়ে শোনানো, তা-ও আবার ব্যাট হাইমসের সুর, নাহ, অসম্ভব। পারবে না। জোরে জোরে চেঁচিয়ে এমননিতেই গলা-মুখ ব্যথা হয়ে গেছে, আর বেশিক্ষণ এই অবস্থা চালালে কথাই বলতে পারবে না শেষে।
ব্যাটল অভ, হাইমসের ধার দিয়েও আর গেল না কিশোর, কিছু মনে করলে করুনগে মহিলা, সে না পারলে কি করবে? নিজেই একটা বেসুরো সুর বানিয়ে নিয়ে চেঁচাল, এখানে আর পারছি না, আর কোথাও চলুন না। অনেক কথা বলার আছে, দয়া করে নবেন কি?
গলায় ঝোলানো তিনরী মুক্তার হারটায় আঙুল বোলাচ্ছেন মহিলা, ছেলেদের দেখছেন। কিশোর ওভাবে খাঁচাটা নিয়ে নেয়ায় মনে আঘাত পেয়েছেন তিনি, তবে প্রকাশ করছেন না।