প্রায় ছোঁ মেরে পাখিটাকে ছিনিয়ে নিল কিশোর। প্রথমেই পা দেখল। পাতলা ধাতুর একটা আঙটা পরানো। কাঁপা হাতে আঙটাটা খুলে ফেলতেই টুপ করে মাটিতে পড়ল উজ্জ্বল একটা কিছু।
উবু হয়ে তুলে নিল কিশোর।
অন্য দুজনও ঝুঁকে এল দেখার জন্যে।
কিশোরের খোলা হাতের তালুতে ঝকমক করছে মস্ত একটা মুক্তো।
যাক, আমাদের অনুমান তাহলে ঠিকই হয়েছে, বলল কিশোর। হ্যারিকিরি, রিচার্ড হ্যারিস, দু-আঙুলা কবুতর…
আমাকে দাও ওটা, কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল কেউ।
ঝট করে ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা।
ওয়ার্কশপের ভেতর থেকে কথা বলেছে লোকটা। জঞ্জালের বেড়া ঘুরে দরজায় বেরিয়ে এল। পরনে কালো অয়েলস্কিন, চোখে কালো চমশা। দাড়িগোফের জঙ্গলের মাঝে একটুখানি পরিষ্কার জায়গা নাকের ফুটো দুটো।
ডান হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগোল লোকটা। শক্ত করে ধরে রেখেছে লম্বা ব্যারেলের একটা পিস্তল।
মুসার মনে হলো নলের কালো ছিদ্রটা তার বুকের দিকেই নিশানা করে আছে। বুক ধড়ফড়ানি শুরু হলো আবার তার। মনে মনে বলল, বলেছিলাম না, রোগটা পারমানেন্ট হয়ে গেছে। আস্তে করে পাশে সরে যাচ্ছে সে, বেড়ার কাছে।
কিশোরের দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা। দাও, মুক্তোটা আমাকে দাও।
লোকটার পিস্তল বা মুখের দিকে নজর নেই কিশোরের, সে তাকিয়ে আছে পায়ের দিকে, জুতোর দিকে। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে মুক্তোটা মুখে পুরে জিভের ডগা দিয়ে ঠেলে একদিকের গালের কোণায় নিয়ে এল সে। শান্তকণ্ঠে বলল, আর এক পা যদি এগোন, মুক্তোটা আমি গিলে ফেলব।
রাগে কেঁপে উঠল লোকটা। ঝাপিয়ে পড়ল কিশোরের ওপর। গলা চেপে ধরতে চায়, যাতে গিলতে না পারে কিশোর।
লাফ দিয়ে এগিয়ে এল রবিন। লোকটার কাঁধ চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল।
সরতে গিয়ে একটা ঝাড়ুর ডাণ্ডায় হোঁচট খেল মুসা।
কিশোরের গলা চেপে ধরে আরেক হাতে পিস্তল দিয়ে বাড়ি মেরে রবিনকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে লোকটা। বুকে বাড়ি খেয়ে ব্যথায় উফ করে উঠল রবিন। কিন্তু লোকটার কাঁধ ছাড়ল না, অয়েলস্কিন খামচে ধরে প্রায় ঝুলে রইল।
ঝাড়া দিয়ে লোকটার হাত ছাড়াতে চাইছে কিশোর। মুক্তোটা গালের কোণে আটকে রেখেছে শক্ত করে।
সরো, রবিন, সরো! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
সাহস ফিরে পেয়েছে আবার গোয়েন্দা-সহকারী। তার এই আরেক গুণ, এমনিতে ভয় পেলেও সত্যিকার বিপদের সময় বাঘের বাচ্চা হয়ে ওঠে সে, রীতিমত দুঃসাহসী বলা যায় তখন।
সরে গেল রবিন। ঝাটার ডাণ্ডা দিয়ে ধা করে নোকটার ঘাড়ে বাড়ি লাগিয়ে দিল মুসা।
কিশোরের গলা ছেড়ে দিল লোকটা, টলে পড়ে যাচ্ছে। হাত থেকে পিস্তল ছুটে গেল, নাকের ওপর থেকে খসে পড়ল চশমা।
কোনমতে সামলে নিল সে আবার, কিন্তু দাঁড়ানোর শক্তি নেই। বসে পড়ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পারলাম না আমি। তোমাদেরই জিত হলো! চোখ টিপল অদ্ভুত ভঙ্গিতে।
পিস্তলটা কুড়িয়ে নিল কিশোর। গুলি আছে?
না না, বাতিল, নষ্ট পিস্তল। বন্দুক-টন্দুককে সাংঘাতিক ভয় পাই আমি, চোখ পিটল লোকটা পর পর দুবার। ইচ্ছে করে করছে না এমন, এটা তার মুদ্রাদোষ। দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।
বাড়ি মারার জন্যে ডাণ্ডা তুলল মুসা।
মেরো না, মেরো না, তাড়াতাড়ি দু-হাত নাড়ল লোকটা। আর ভাল লাগছে না আমার এসব। কেন যে মরতে এই অকাজ করতে গিয়েছিলাম। সব সর্বনাশের মূল ওই ঘোড়া, বুঝেছ, ঘোড়া। রেস খেলে ফতুর হয়ে গেছি, ধারকর্জ করে করে…লোকজন তাগাদা দিচ্ছে টাকার জন্যে। তাই কিছু টাকা জোগাড় করতে চেয়েছিলাম।
লোকটার জন্যে এখন দুঃখই হচ্ছে কিশোরের। হয়ে যেত জোগাড়, মিস কারমাইকেলের বাজপাখিগুলোর জন্যে পারলেন না।
মুখ থেকে মুক্তোটা বের করে পকেটে রেখে দিল কিশোর।
চুপচাপ দেখল লোকটা, অসহায় ভাবভঙ্গি।
ওগুলো আর খামোকা লাগিয়ে রেখেছেন কেন? বলল কিশোর। ওই দাড়িগোঁফ। খুলে ফেলুন। অস্বস্তি লাগছে না?
হ্যাঁ, খুলেই ফেলি, চোখ টিপল রিংকি।
দাড়িগোঁফ আর কালো অয়েলস্কিন খুলে ফেলার পর উলঙ্গ মনে হলো অসকার স্লেটারকে। দেহের আকারও যেন এক ধাক্কায় কমে গেছে অনেক।
নার্ভাস ভঙ্গিতে ক্রমাগত চোখ টিপে যাচ্ছে লোকটা। রবিন আর মুসাকে পাহারায় রেখে থানায় ফোন করতে চলল কিশোর।
১৪
সব স্বীকার করেছে অসকার স্লেটার, বলল কিশোর। তিনজনকেই অ্যারেস্ট করে হাজতে ভরেছিল পুলিশ। রিংকি, রিচার্ড হ্যারিস, হ্যারিকিরি। হ্যারিস আর হ্যারিকিরি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু রিংকি ইচ্ছে করেই রয়ে গেছে হাজতে, জামিনে মুক্তি নেয়ার চেষ্টা করছে না। ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, গোপনে বলেছে আমাকে একথা হাজতে থাকলেই নাকি এখন তার ভাল, নিজেকে শোধরাতে বাধ্য হবে! রেস খেলা বন্ধ হবে। তবে আমার ধারণা, আসল কারণটা অন্য, হ্যারিস আর হরিকিরির ভয়েই আসলে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না।
বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। তাদের এবারকার কেসের রিপোর্ট দিচ্ছে পরিচালককে!
ওদের মুক্তো চুরির খবর জানল কি করে ব্লিংকি? জিজ্ঞেস করলেন পরিচালক।
রিচার্ড হ্যারিসের চাকরি করত সে, জবাব দিল রবিন। কবুতর দেখাশোনা করত, গহনার দোকানেও সাহায্য করত মাঝেসাঝে। তারপর একদিন কাশ চুরি। করে ধরা পড়ল! বের করে দিল তাকে হ্যারিস। কিন্তু ততদিনে হ্যারিসের গোপন ব্যবসার অনেকখানিই জেনে ফেলেছে রিংকি, জেনে গেছে বেআইনী পথে মুক্তো। আসে।