পৌঁছে গেছে কিশোর! সাবধানে দরজার হাতল ধরে ঘোরাল। খুলে ফেলল দরজা।
পাহাড়ের ওপর থেকে রবিন দেখতে পাচ্ছে ভালমত।
কিশোরকে নিচু হয়ে গাড়িতে ঢুকে যেতে দেখল। হাতের রুমালটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল সে।
আছে, গাড়ির পেছনে,খাঁচাটা আছে। ওটা সরিয়ে টমের খাঁচাটা ওই জায়গায় রেখে দিল কিশোর। কানে আসছে মুসার কণ্ঠ, যত ভেলকিই দেখাও বাবা, জায়গা ছেড়ে আমি নড়ছি না…আঁউ! চমকে গেছে কোন কারণে, থেমে গেল কণ্ঠস্বর। কিশোর জানে না, পয়সা নয়, ছুরি বের করেছে হ্যারিকিরি। লম্বা, বাকা, ঝকঝকে ফলা।
দরজা বন্ধ করে দিল কিশোর। ফটাস করে শব্দ হলো, বেলুন ফুটল বোধহয়।
এগিও না, খবরদার! জোর নেই মুসার গলায়।
আরও কয়েকটা বেলুন ফুটল ফটাস ফটাস করে।
চেঁচিয়ে উঠল মুসা, কিশোর, জলদি করো! আর আটকাতে পারছি না। ছুরি চালাচ্ছে ব্যাটা, বেলুনগুলোর দফারফা, আমারও হবে…
দরজা খুলে লাফিয়ে নামল কিশোর, নিঃশব্দে। খাঁচাটা দুহাতে ধরে রেখেছে। বুকের ওপর। একবারও ফিরে না তাকিয়ে সোজা দৌড় দিল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।
ভাগো, কিশোর, জলদি করো! বেলুনগুলো হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে মুসা, এদিক ওদিক উড়ছে আর রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে ওগুলো। তার ভেতরে একবার এদিকে লাফ দিয়ে পড়ছে সে, একবার ওদিক, হ্যারিকিরির ছুরির পোচ থেকে বাচার জন্যে। বার বার তাকাচ্ছে ছোট পাহাড়টার দিকে। ইস্, এত দেরি হচ্ছে কেন?
ছুটে পালাবে কিনা ভাবছে মুসা, এই সময় দেখতে পেল রবিনকে। পাগলের মত রুমাল নাড়ছে সামনে-পিছনে।
এগিয়ে আসছে হ্যারিকিরি।
দু-হাত সামনে তুলে তাকে বলল মুসা, যাচ্ছি, বাবা, যাচ্ছি, সরে যাচ্ছি। আমাদের কাজ শেষ। জাহান্নামে যেতে পারো এবার তুমি। বলেই ঘুরে দিল দৌড়, সরে চলে গেল রাস্তা থেকে।
গাড়িতে ফিরে গেল হ্যারিকিরি। চলে গেল শাঁ করে। চাকার নিচে পড়ে ফাটল আরও কয়েকটা বেলুন।
ধপ করে বসে পড়ল মুসা তুলসীবনের ধারে। হাঁপাচ্ছে।
খাঁচা হাতে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। কাছে এসে মুসার কাঁধে হাত রেখে শুধু বলল, থ্যাংক ইউ।
রবিনও এসে দাঁড়াল। মুসা, তোমার হয়নি তো কিছু? পোঁচটোঁচ লাগেনি?
ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল মুসা। না, বেলুনগুলোর ওপর দিয়ে গেছে। তবে আমার বুকের ধড়ফড়ানি বোধহয় আর কোনদিন যাবে না। পারমানেন্ট রোগ বাধালাম।
১৩
যাই হোক, জিরিয়ে নিয়ে বলল কিশোর, কাজ হয়েছে। গাড়িতে করে টমকে নিয়ে গেছে হ্যারিকিরি।
তা গেছে, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল মুসা। কিন্তু এরপর কি?
খাঁচার চীজক্লথ খুলছে কিশোর। আমাকে একটু সাহায্য করবে, রবিন?
চীজক্লথ ছিড়ে খাঁচার দরজা খুলে পায়রাটাকে বের করল দুজনে।
ধরো, শক্ত করে ধরে রাখো, বলল কিশোর।
রবিন ধরে রাখল।
পকেট থেকে একটা অ্যালুমিনিয়মের পাতলা পাতের আঙটা বের করে লাগিয়ে দিল কিশোর কবুতরের পায়ে, তাতে কায়দা করে লাগিয়ে দিল তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড। কার্ডটা ভাঁজ করে শক্ত করে গুঁজে দিয়েছে আঙটার ভেতরে, কেউ না খুললে আপনা-আপনি খুলে পড়বে না। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে পায়ের সঙ্গে শক্ত করে টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দিল।
মুসা, বলল কিশোর, পায়রাটাকে ছাড়ার সম্মান তোমারই প্রাপ্য।
খুশি হলো মুসা। কবুতরটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এক হাতে ধরে রেখে আরেক হাত ওটার পিঠে বুলিয়ে আদর করল। বলল, বাড়ি যাও, খোকা, বলে উড়িয়ে দিল।
কয়েক সেকেণ্ড মাথার ওপর ফড়ফড় করল পাখিটা, তারপর কোণাকুণি উড়ে শ করে উঠে গেল রকেটের মত, তীব্র গতিতে উড়ে গেল উপকূলের দিকে।
দুই ঘণ্টা পর ইয়ার্ডে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।
এসেছ, ওদের দেখেই এগিয়ে এলেন মেরিচাচী। আমি তো ভাবলাম, দিনটাও কাটিয়ে আসবে কিশোর, একগাদা মাল নিয়ে এসেছে তোর চাচা। বোরিস আর রোভার মাল আনতে গেছে আরেকখানে, তোরা একটু হাত লাগাবি?
মাথা কাত করল কিশোর। কাজ করতে অসুবিধে নেই। দুপুরের দেরি আছে এখনও আরও দু-ঘন্টা। তাছাড়া অপেক্ষার মুহূর্তগুলো হয় বড় দীর্ঘ। কাজ করলে, বরং দ্রুতই কাটবে সময়।
হাত চালাচ্ছে বটে, কিন্তু কাজে মন নেই ওদের। বার বার তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। কান খাড়া করে রেখেছে ডানার ঝটপট শব্দের জন্যে।
সাড়ে এগারোটার দিকে চাচাকে ড্রাইভার বানিয়ে নিয়ে চাচী গেলেন বাজার করতে। দুটোর আগে ফিরবেন বলে মনে হয় না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। চাচীর সামনে কবুতরটা নামলে প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জান খারাপ হয়ে যেত ওর। সেদিক থেকে আপাতত নিশ্চিন্ত।
দুপুরের আগে কাজ থামিয়ে দিল ওরা। ওয়ার্কশপের বাইরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। আকাশের দিক থেকে চোখ নামাচ্ছে না তিনজনের একজনও।
বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। কিন্তু বোকা বনে গেল পরমুহূর্তেই। একটা সোয়ালো উড়ে চলে গেল স করে।
ঠিক কখন যে ছাড়বে হ্যারিকিরি, জানি না, বলল কিশোর। হয়তো আগে খাওয়া-দাওয়া, তারপর…
আবার লাফিয়ে উঠল মুসা।
না, এবার আর ভুল করেনি।
কিশোর আর রবিনও দেখল, চকচকে পালক। মাথার ওপর একবার চক্কর দিয়ে নেমে আসতে শুরু করল।
টম! হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ডাকল মুসা। টম! এই যে, এখানে টম!
টমও দেখেছে। গোত্তা দিয়ে নেমে পড়ল একেবারে মুসার বাড়ানো হাতের তালুতে। বার দুই ডানা ঝাপটে চুপ হয়ে বসল।