বাবার কালো চশমাটা নিয়ে এসেছে মুসা, বের করে পরল। কি করে জানছি সে আসছে? গলা কাপছে মৃদু।
তিনবার শিস দিলে বুঝবে গাড়ি দেখা যাচ্ছে, বলল কিশোর। আমাকে পেরিয়ে যাওয়ার পর আরও দুবার শিস দেব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
মুসার কষ্ঠে অনিশ্চয়তা বুঝতে পারল কিশোর। খারাপ লাগছে তার, সব চেয়ে কঠিন কাজটা করতে হচ্ছে মুসাকে। সে নিজে পারলে ভাল হত। কিন্তু অতিরিক্ত ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে তাতে, সব কিছু ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। এতদূর এগিয়ে সব গণ্ডগোল করে দিতে চায় না। তাকে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলবে হ্যারিকিরি, ইয়ার্ডে তার সঙ্গেই কথা বলেছে।
মুখ গোমড়া করে রেখেছ কেন? বন্ধুকে ভরসা দিল কিশোর। হাসো, হাসি হাসি করে রাখা। কথা বলবে সহজ ভাবে। গোমড়ামুখ লোককে চাদা দেয় না কেউ।
কি বলব?
যা মুখে আসে। ব্যাটা ইংরিজি বোঝে না।
আচ্ছা, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা।
ঘড়ি দেখল কিশোর। সময় হয়ে গেছে।
ছোট পাহাড়টায় উঠে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসল রবিন।
কিশোর গিয়ে ঢুকল তুলসীবনে, সাইকেলগুলো যেখানে রেখেছে। মুসা যেখানে আছে জায়গাটা তার চেয়ে উঁচু। কবুতরের খাঁচাটায় হাত রেখে তৈরি হয়ে রইল।
বেলুনের পাহাড়ের পাশে ধপ করে বসে পড়ল মুসা, বিড়বিড় করল, আমাদের ডানাওয়ালা বন্ধুদের রক্ষা করুন। জাহান্নামে যাক ডানাওলারাহ! আমাকে রক্ষা করে কে?
রোদ চড়েনি, আবহাওয়া ঠাণ্ডা, কিন্তু দরদর করে ঘামছে কিশোর। জুলফির কাছ থেকে ঘাম গড়িয়ে গাল বেয়ে এসে জমা হচ্ছে চিবুকে, সেখান থেকে টুপ করে পড়ছে তুলসী পাতায়। তুলসীর নেশা ধরানো গন্ধ ভোরের বাতাসে, কিন্তু উপভোগ করার সময় এখন নেই। মুসার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, ভাবছে আবল-তাবল, নিজেকে ধমক লাগাল সে। চোখ ফেরাল বায়ে, পথের দিকে, যেখান দিয়ে আসবে সবুজ ভ্যানটা।
এক মিনিট গেল…পাঁচ মিনিট…দশ…আসবে তো? নাকি আজ হ্যারিকিরির ছুটি? কোথাও কোন কারণে আটকে গেল? না আসুক, সে-ই ভাল, তাহলে খারাপ কিছু ঘটা থেকে বেঁচে যাবে মুসা।
ঠিক এই সময় শোনা গেল ইঞ্জিনের শব্দ।
মুখে আঙুল পুরে তিনবার তীক্ষ্ণ শিস দিল কিশোর।
গাড়িটা গো গো করে বেরিয়ে গেল তার সামনে দিয়ে। আরও দুবার শিস দিল সে।
গাড়িটা বাঁকের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যেতেই খাঁচাটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তুলসীবন ভেঙে দুপদাপ করে এসে পড়ল রাস্তায়, দৌড় দিল গাড়ির পেছনে।
শিসের শব্দ শুনে উঠে দাঁড়িয়েছে মুসাও। সবগুলো বেলুনের মুখে বাধা-লম্বা সুতোর মাথা এক করে ধরে রেখেছে, হ্যাঁচকা টানে সব নিয়েই এসে নামল রাস্তায়। দ্বিতীয়বার শিস যখন দেয়া হলো, একগাদা বেলুনের মাঝে শুধু বেরিয়ে আছে তার চশমা পরা মুখটা।
দেখা গেল গাড়ি। গতি কমছে। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে থেমে গেল বেলুনের ব্যারিকেডের কয়েক গজ দূরে।
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে কিছু বলল হ্যারিকিরি, জাপানী ভাষায়।
শুনতেই যেন পায়নি মুসা, ভাব দেখাল রেলুন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আসলে ব্যারিকেড আরও ছড়িয়ে দিচ্ছে সুতোয় ঝাঁকুনি দিয়ে, গাড়ি বেরোনোর পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। হালকা বাতাসে রঙিন একটা দেয়াল গজিয়েছে যেন পথের ওপর।
গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এল হ্যারিকিরি। মুসার দিকে চেয়ে বিস্ময় ফুটল চোখে। সব চেয়ে কাছের বেলুটা সই করে ধা করে এক লাথি চালাল। বাতাসে দোল খেল বেলুনটা, আলতো করে গিয়ে লাগল তার নিজেরই নাকে। থাবা দিয়ে চোখের সামনে থেকে ওটা সরিয়ে আবার কিছু বলল সে।
জোর করে হাসল মুসা। আমাদের ডানাওয়ালা বন্ধুদের রক্ষা করুন, একটা বেলুন কিনুন।
জাপানীতে বিড়বিড় করল হ্যারিকিরি।
হাসি বজায় রাখল মুসা। যা খুশি বলবে, বলে দিয়েছে কিশোর। কিন্তু যাখুশিও মুখে আসছে না এখন মুসার। বেকায়দা অবস্থায় পড়ে রেগে গেল সে। চুলোয় যাক ডানালার বাচ্চারা। নাক ভোতা জাপানীর বাচ্চা জাপানী, চোরের শুষ্টি চোর, ব্যাটা মুক্তো চুরি করে এখন আমাকে ফেলেছিস বিপদে। বেলুন কিনবি তো কেন, নইলে… গাল দিয়ে মনের ঝাল মেটাতে পেরে এতক্ষণে সত্যি সত্যি হাসি ফুটল তার মুখে। দুঃখিত, চোরা সাহেব, আপনাকে জায়গা দিতে পারছি না। কিশোর, নিষেধ করেছে। আপনি এখানে আটকে থাকলে আমাদের বিশেষ সুবিধে। আপনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে শ্রীঘরে পাঠিয়ে দিতে চাই তো, তাই এই ব্যবস্থা। না, বেশিক্ষণ আটকাব না, চোখের কোণ দিয়ে দেখল, কিশোর দৌড়ে আসছে, গাড়ির দশ গজ দূরে রয়েছে। পায়ে মীকার পরা থাকায় শব্দ হচ্ছে না।
সব চেয়ে শক্ত কাজটা এখন করতে হবে কিশোরকে, হ্যারিকিরির অলক্ষে খুলতে হবে ভ্যানের পেছনের দরজা। কোন রকম শব্দ করা যাবে না। ভ্যানের ইঞ্জিন চালু রয়েছে, এটাই ভরসা।
চাইলে তোমার কারাতে এসে পরীক্ষা করতে পারো আমার ওপর, সাহস ফিরে পেয়েছে মুসা। ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের নাকানিচোবানি খাইয়ে এসেছে ওরা, আর সামান্য একটা পুঁচকে জাপানীর ভয়ে মচকে যাবে, এ হতে পারে না, নিজেকে বোঝাল সে। তুমি দশটা দিলে আমি একটা তো দিতে পারব। জোরে জোরে বলল কিশোরের কাছে শেখা বাংলা কবিতার একটা লাইন, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব, সূচ্যগ্র মেদিনী:
পকেটে হাত ঢোকাল হ্যারিকিরি।
কি খুঁজছে ব্যাটা? কণ্ঠস্বর আরও চড়িয়ে বলল মুসা, আল্লাহরে, ব্যাটা আবার পিস্তল বের করবে না তো? নাহ্ হয়তো পয়সা…