তারের বেড়ার দিকে তাকাল কিশোর। গেটের কাছে আসেনি জাপানী শ্রমিকেরা, একটা কুঁড়েতে ঢুকেছে। গার্ডদেরও কেউ বাইরে নেই, ওরাও ঢুকেছে শ্রমিকদের সঙ্গে।
এক লাফে উঠে দাঁড়াল সে। দুটল সরু পথ ধরে পার্কিং লটের দিকে।
চোখ মেলল রবিন। পাশে কেউ নেই। কিশোর গেল কোথায়? পার্কিং লটের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সবুজ ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে ঢুকে যাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। বন্ধ হয়ে গেল আবার দরজা।
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। করছে কি?
চুপ! হুঁশিয়ার করল রবিন। আমরা এখন কি করি?
কিছু তো বলে গেল না। তোমার কি মনে হয়? হ্যারিকিরির গাড়িতে লুকিয়ে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে?
জানি না, মাথা নাড়ল মুসা। কিন্তু আমাদের কিছু করতে হবে মনে করলে বলেই যেত। নাকি?
তা ঠিক। ভ্যানটা খুঁজে দেখতে গেল না তো? দেখি, কি করে? হ্যারিকিরির হাতে ধরা না পড়লেই হয়… কিশোরের ফেলে যাওয়া বিনকিউলারটা তুলে নিল রবিন। সাকো, বেড়ার আশপাশ আঁতিপাতি করে খুঁজল। নির্জন একটা কুঁড়ের জানালায় চোখ পড়তেই থেমে গেল হাত।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে বোঝা গেল ঘরটাতে শ্রমিক আর গার্ডে গিজগিজ করছে। শ্রমিকেরা সব কাপড় খুলে ফেলেছে। মনে হচ্ছে তল্লাশি চালাচ্ছে গার্ডেরা, শ্রমিকদের কাপড়-চোপড় খুঁজছে, লাঞ্চ বাক্সের ভেতরে দেখছে।
বিনকিউলার নামাল রবিন। দৌড়ে আসছে কিশোর। ধপাস করে এসে বসে পড়ল পাশে। মুখ লাল, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। চোখে উত্তেজনা।
জিরিয়ে নিয়ে বলল, গার্ডরা ওদের সার্চ করছে, না?
তাই তো মনে হলো, মাথা ঝাঁকাল রবিন। তুমি জানলে কি করে? কি খুঁজছে ওরা?
দেখে এসেছি, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল কিশোর, প্যাকেটে কি আছে। মুসা, আলো তখন কম ছিল তো, বুঝতে পারোনি। ধূসর জিনিসটা খবরের কাগজ নয়, চীজকুথ।
চীজকুথ, হা হয়ে গেছে মুসা। মানে, ব্রিংকির প্যাকেটটার মত?
অবিকল এক জিনিস। ছেড়া খাঁচাটা পড়ে আছে। খালি। তবে বাজি রেখে বলতে পারি, সকালে রিচার্ড হ্যারিস যখন রেখে গেছিল, তখন খালি ছিল না। কারণ, এই জিনিস পেয়েছ ভেতরে,মুঠো খুলে দেখাল কিশোর, কি পেয়েছে।
পায়রা, চোখ ছোট হয়ে গেছে মুসার। খাঁচার মধ্যে কবুতর ছিল…
এবং সেটাকে লাঞ্চ বক্সে ভরে গেট পার করে নিয়ে গেছে। দারুণ ফন্দি। ঢোকার সময় শ্রমিকদের টিফিন বক্স পরীক্ষা করেনা গার্ডরা, বেরোনোর সময় করে।
ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেছে রবিনের। কেন করে? কি খোঁজে?
মুক্তো, শান্তকণ্ঠে বোমাটা ফাটাল কিশোর।
১১
মুক্তো, আবার বলল কিশোর। মুক্তো এবং রেসিং হোমার কবুতর।
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। বিকেলে অসময়ে ফিরে এসে মেরিচাচীর বকাঝকা আর তার হাতে তৈরি অনেকগুলোস্যাণ্ডউইচ খেয়ে পেট ভরেছে মুসা আর কিশোর।
দুধের গেলাসটা হাতে নিয়ে গিয়ে ফ্রিজ খুলেছে কিশোর, হতাশা চেপে রাখতে পারেনি, মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেছে, দৃর, নেই।
এই, কি নেই রে? কাছেই বসা ছিল চাচী।
আপেলের হালুয়া। বেশি করে কাঁচা মাখন দেয়া।
হঠাৎ করে হালুয়া খাওয়ার শখ হলো কেন? অন্য সময় তো সাধাসাধি করেও গেলাতে পারি না।
দুপুরে স্বপ্নে খেলাম তো, তখন থেকেই খেতে ইচ্ছে করছে।
স্বপ্ন দেখলি?কোথায় ঘুমিয়েছিলি? উঠে দাঁড়াচ্ছেন মেরিচাচী।
চুপ হয়ে গেল কিশোর। অনেক বেশি বলে ফেলেছে।
তুলসীবনে, চাচী, বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, ঢাকতে গিয়ে আরও ফাঁস করে দিল মুসা।
প্রমাদ গুণল কিশোর, তাড়াতাড়ি বলল, ওই পাহাড়ের ধারে, চাচী তুলসী গাছ ছিল কাছে, তার ছায়ায়। সাইকেল চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে জিরোতে বসেছিলাম, কখন যে তন্দ্রা এসে গেল…হি-হি…তো চাচী, হালয়া…
কোথায় যে কবে মরে পড়ে থাকবি, চাচীর মুখের মেঘ সরছে না। এই, তুলসীবন থেকে যদি সাপ বেবরাত? যদি…
দূর, চাচী, তুমি কিছু জানো না, হাত তুলল কিশোর। তুলসীবনে সাপ থাকে না।
তবে কি থাকে?
কিছুই থাকে না। হ্যাঁ, চাচী, হালুয়া…আপেল আছে তো, নাকি বাজার থেকে এনে দেব?
আছে আছে, রাতে খাস, বানিয়ে রাখব। তবে কথা দিতে হবে, তুলসীবনে…
ঠিক আছে, চাচী, আর যাব না, যাও, এক চুমুকে বাকি দুধটুকু খেয়ে মুসার হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে কিশোর, চাচী আর কিছু বলার আগেই। সোজা এসে ঢুকেছে দুজনে হেডকোয়ার্টারে।
রবিন পরে এসেছে। কিশোরের অনুরোধে লাইব্রেরিতে গিয়েছিল দুটো বই আনতে,পথে রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছে।
হ্যাঁ, রবিনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মুক্তো চাষের ব্যাপারে কি লিখেছে বইতে?
মূল্যবান পাথরের ওপর লেখা বইটা খুলল রবিন। ভেতরে এক পাতা আলগা কাগজ, তাতে নোট লিখেছে সে। হ্যাঁ, মুক্তোর চাষ।…স্প্যাট, মানে শিশু ঝিনুক জোগাড় করে খাঁচায় ভরে পানিতে ডুবিয়ে রেখে দেয়া হয়। এগুলোর বয়েস যখন তিন বছর হয়, তুলে ফাক করে ভাঙা এক কণা মুক্তো ফেলা হয় ভেতরে। তারপর ঝিনুকগুলোকে আবার খাঁচায় ভরে ডুবিয়ে রাখা হয় পানিতে। শক্ত পাথর অস্ত্রের কাছের বিশেষ থলিতে আটকে খুব যন্ত্রণা দেয় ঝিনুককে, আপনা আপনি এক ধরনের রস বেরিয়ে তখন লাগতে থাকে কণাটার সঙ্গে, শক্ত হয়ে জমতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে কাটা, পূর্ণাঙ্গ মুক্তোয় রূপ নেয় এক সময়। তিন থেকে ছয় বছর লাগে একটা মুক্তো তৈরি হতে।