আর অপেক্ষা করে লাভ নেই, কিশোরকে জানানো দরকার। আসার সময় দেখেছে, মাইল খানেক দূরে একটা পেট্রল স্টেশন গেছে। ঝোপ থেকে সাইকেল বের করে চড়ে বসল মুসা।
একবার বাজতেই ওপাশ থেকে রিসিভার তুলল কিশোর। খুলে বলল সব মুসা। জানাল, এখন উইলস বীচের মাইলখানেক দূরে রয়েছে। কিশোর আর রবিনের জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবে সে।
সাইকেলটা দারুণ।
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে ফিরে চাইল মুসা। তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় একটা ছেলে চকচকে চোখে দেখছে ইংলিশ রেসারটাকে। স্টেশনেরই কর্মচারী।
ধন্যবাদ জানাল মুসা।
পাশে বসে পড়ল.ছেলেটা। মুসার মতই সাইকেলের ভক্ত, বোেঝা গেল কয়েকটা কথা বলেই। বেশ ভালই জমল ওদের আলোচনা। সাইকেল সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ছেলেটার, বকবক করে চলল একনাগাড়ে।
এক সময় মুসার মনে হলো, তাই তো, খালি সাইকেল কেন, আরও তো কিছু জানা যেতে পারে ছেলেটার কাছে? জিজ্ঞেস করতে দোষ কি?
আচ্ছা, মুসা বলল, মেইন রোড থেকে একটা সরু পথ নেমে গেছে না সাগরের দিকে, এই তো মাইলখানেক দূরে, কাঁটাতারের বেড়া, গার্ড। ব্যাপারটা কি, বলো তো? – শুনেছি, ঝিনুকের খামার। কয়েক বছর আগে এক ধনী জাপানী করেছে ওটা। বিরাট দীঘি খুড়ে তাতে সাগরের পানি ঢোকার ব্যবস্থা করেছে। ওখানে নাকি ঝিনুকের চাষ করে।
আর কিছু জানা গেল না ছেলেটার কাছে, জানে কিনা জিজ্ঞেস করার সুযোগও অবশ্য হলো না মুসার। গাড়ির ভিড় বেড়েছে, পেট্রল নিতে ঢুকছে, সবারই তাড়া দিতে একটু দেরি হলেই রেগে যাচ্ছে। হাত থেকে পাম্প রাখারই সময় পাচ্ছে না ছেলেটা।
কিশোর আর রবিন পৌঁছে গেল। পরিশ্রমে লাল দুজনের মুখ, ঘামছে, হাঁপাচ্ছে। আরও দুটো কোকাকোলার টিন আনতে গেল মুসা, ইতিমধ্যে ফোয়ারার পানিতে হাত-মুখ-মাথা ভিজিয়ে নিল কিশোর। তিনজনেই গিয়ে বসল আবার ছায়ায়। পেট্রল স্টেশনের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে যা জানা গেছে, কিশোরকে
জানাল মুসা।
ঝিনুকের খামার, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। সিকিউরিটি গার্ড। রিচার্ড হ্যারিস। বাদামী কাগজে মোড়া বড় প্যাকেট। কাজের কাজ করেছ, মুসা।
তাই নাকি? তা কি করেছি বলো না শুনি। আমি তো ছাই কিছুই বুঝতে পারছি না।
জবাব দিল না গোয়েন্দাপ্রধান। উঠে দাঁড়াল। চলো, যাই। লুকানোর ভাল একটা জায়গা খুজে বের করতে হবে। ওরা কি করে দেখব।
এক সারিতে সাইকেল চালাল তিন গোয়েন্দা।
কয়েক মিনিট পরে পৌঁছে গেল সরু রাস্তা আর বড় রাস্তার মিলনস্থলে। এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করল যেখানে তুলসীর ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে সরু পথ, বড় রাস্তা আর ঝিনুকের খামারের ওপর এক সঙ্গে চোখ রাখা যায়।
বিনকিউলার নিয়ে খানিকক্ষণ দেখে বলল কিশোর। তারের বেড়ার জন্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঝিনুক নিয়ে ওরা কি করছে বোঝা যায় না। ঝিনুকগুলো খুলছে মনে হচ্ছে।
অনেক ওপরে উঠেছে সূর্য, কড়া রোদ। পেট্রল স্টেশন থেকে আরও কয়েক টিন কোকাকোলা নিয়ে আসা উচিত ছিল, ভাবল মুসা। সানগ্লাস বের করে চোখে লাগাল। তারপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল ছায়া ছায়া ঝাড়ের ভেতরে। কালো কাচের জন্যে আলো কম লাগছে চোখে।
দুপুরের দিকে গার্ডের বাশি বাজল। শ্রমিকদের খাবার সময়। সঁকোতে রোদে বসেই টিফিন বাক্স থেকে খাবার বের করে খেতে শুরু করল ওরা।
মাথার ওপর, আশেপাশে কবুতর আর সীগালের ভিড় জমে গেল, খাবারের উচ্ছিষ্টের লোভে। হেই, যাহ, হুসস এমনি নানারকম শব্দ করে ওগুলোকে দূরে রাখার চেষ্টা করল শ্রমিকেরা। অবশেষে খাওয়ার আশা ছেড়ে একে একে উড়ে চলে গেল বেশির ভাগ পাখি।
বিনকিউলার চোখ থেকে নামাল কিশোর। জাপানীয়ে খেতে দেখে তারও খিদে লেগে গেল। জোর করে খাওয়ার ভাবনা দূর করে রহস্য সমাধানে মনোনিবেশের চেষ্টা চালাল সে। আনমনে চিমটি কাটতে শুরু করল নিচের ঠোঁটে।
ধূসর কাগজে মোড়া প্যাকেটটা ভ্যানের পেছনে রাখল হ্যারিস। কি ছিল তাতে মুসা দেখেছে, প্যাকেটটা গাড়িতে রেখে শুধু লাঞ্চ বক্স হাতে নিয়ে বেড়ার ভেতরে ঢুকেছে হ্যারিকিরি।
মুসার গায়ে ঠেলা দিল কিশোর। হ্যারিকিরি ভ্যানের পেছনের দরজায় তালা লাগিয়েছে?
মাথা তুলল মুসা। না, ঘুম জড়ানো কণ্ঠ, লাগায়নি। কেন? জবাবের, অপেক্ষা না করেই আবার শুয়ে পড়ল।
যাবে নাকি, ডাবল কিশোর, গিয়ে দেখবে প্যাকেটটায় কি আছে? সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দিল ভাবনাটা। শ্রমিকেরা খেতে বসেছে বটে, কিন্তু গার্ডরা সতর্ক। গেটের কাছে রয়েছে একজন সারাক্ষণই।
কয়েক মিনিট পর আবার বাশি বাজল। টিফিন বাক্স রেখে আবার কাজে লাগল। শ্রমিকেরা।
চোখ ভোলা রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করল কিশোর, পারুল না। কোন কিছুই আর দেখার নেই, বিনকিউলারের ভেতর দিয়েও না। স্তব্ধ গরম, নীরবতা, ক্ষুধা সব কিছু মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে যেন, চোখ খোলা রাখতে পারছে না কিছুঁতেই। অবশেষে মুসার পাশেই গড়িয়ে পড়ল সে।
স্বপ্ন দেখছে কিশোর, আপেলের হালুয়া খাচ্ছে, তাতে প্রচুর কাঁচা মাখন মেশানে। এক চামচ খেয়ে আরেক চামচ তুলে নিতে গেল।
বাঁশির তীক্ষ্ণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘড়ি দেখল, তিনটে বাজে। জাপানীরা খাঁচাগুলো নামিয়ে রাখছে পানিতে।
আজকের মত দুটি। গেটের দিকে এগোল শ্রমিকেরা।
ঘুমিয়ে নেয়ায় মাথা একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে কিশোরের। তাই বোধহয় মুসার কালো চশমার দিকে চেয়ে চকিতে মনে পড়ে গেল কথাটা। মিস কারমাইকেলের বাগানে আর ট্রাসটি ব্যাঙ্কের পার্কিং লটে সাগ্লাস পরেছিল রিচার্ড হ্যারিস। দুবারই রাতে। কালো কাচ শুধু আলোই ঠেকায় না, চোখও ঢেকে রাখে অন্যের নজর থেকে। এই তো, এত কাছে থেকেও মুসার চোখ দেখতে পাচ্ছে না সে। বুঝতে পারছে না, খোলা না বন্ধ।