কোস্ট রোডের দিকে মোড় নিল ভ্যান। গতি বাড়ছে ওটার, মুসাও বাড়াচ্ছে সাইকোটার গতি এভাবে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ হয়নি আগে, খুশিই হলো নে, গাড়ির একশো গজ পেছনে থেকে প্যাডল ঘুরিয়ে চলেছে দ্রুত, আরও দ্রুত।
স্ন্যাকস রেস্টুরেন্টকে যখন পাশ বাড়াচ্ছে…তিরিশ…পঁয়তিরিশ…চল্লিশ, টপ গীয়ারে চলছে এখন সাইকেল।
কয়েক মিনিট পর উইস বীচ পেরোল ওরা। এখানকার সৈকতে ক্যাম্প করার অনুমতি আছে, তবে আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ। ঝকঝকে বালিতে কয়েকটা তার টানো। একটা তবু থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে এল। মুসার দিকে হাত নাড়ল। কি ব্যাপার? পরিচিত কেউ নাকি? কিন্তু ভালমত খেয়াল করার সময় এখন নেই তার।
উইলস বীচের মাইল দুয়েক দূরে সাগরের দিকে মোড় নিয়েছে রাস্তাটা। দূরে সাগরের দিকে তাকাল সে তৃষিত নয়নে। বড় বড় ঢেউ ভাঙছে। গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করল।
চোখ ফিরিয়েই চমকে গেল! সহসা ব্রেক চেপে ধরায় তীব্র প্রতিবাদের ঝড় লল সাইকেলের টায়ার, কর্কশ আর্তনাদ করে পিছলে গেল কয়েক গজ, ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে দাঁড়াল।
ভ্যানের পেছনের লাল লাইট জ্বলছে আর নিভছে, হুশিয়ার করে দিচ্ছে পেছনের যানবাহনকে।
হ্যান্ডেল চেপে ধরে সীটেই বসে রইল মুসা। সামনে থেমে গেল ভ্যান। মনে পড়ল, হ্যারিকিরির সদাসতর্ক দৃষ্টির কথা। জাপানীরাই কারাতে নামক ভয়ঙ্কর মারপিটের আবিষ্কর্তা, কথাটা মনে হতেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। তৈরি হয়ে গেল পালানোর জন্যে। একটু এদিক ওদিক দেখলেই ছুটে পালাবে। লজ্জা কিসের, কেউ যদি না দেখল? এখানে তার বন্ধুরা কেউ নেই, টিটকারি মারার মত শত্রুও নেই। শুটকি টেরির কথা মনে পড়ল হঠাৎ করেই। সেই যে করে নিউ ইয়র্ক গেছে টেরিয়ার ডয়েল, আর দেখা নেই, ফেরেনি রাক বীচে। কড়া শাসনে রেখেছে বোধহয় তার বাবা। শুটকিকে পছন্দ করে না তিন গোয়েন্দা, কিন্তু ও না থাকলে জমে না।
চলতে শুরু করেছে সবুজ ভ্যান। ধীরে ধীরে এগিয়েই মোড় নিল বলে।
সাগরের দিকে চলে গেছে একটা সরু পথ, এতক্ষণ দেখেনি মুল, খেয়ালই করেনি। সাবধানে প্যাডাল ঘোরাল সে। থেমে গেল মোড়ে এসে। গজ তিরিশেক দুরে একটা পার্কিং লটে গিয়ে শেষ হয়েছে সরু পথ। তারপরে মোটা কাটা তারের বেড়া, গেট। তার ওপাশে কাঠের একগুচ্ছ কুড়ে।
পার্কিং টে থামল সবুজ ভ্যান।
কড় রাস্তার ধারে বনতুলসীর ঝাড় ঘন হয়ে জন্মেছে, সাইকেলটা তার মধ্যে শুইয়ে নিজেও ঝাড়ের ভেতর উপড় হয়ে শুয়ে পড়ল মুস!। দেখন, ভ্যান থেকে নেমে লাঞ্চ বক্স হাতে গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে হ্যারিকিরি, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বন্ধ করে দিল আবার দরজা।
ব্যাপার কি, বেরোচ্ছে না কেন লোকটা? এত দেরি? করছে কি ভেতরে কাপড় বদলাচ্ছে?
বদলায়নি, আগের পোশাকেই বেরিয়ে এল হ্যারিকিরি। হাতে লাঞ্চ বক্স। দুহাতে ধরে সেটা সামনে বাড়িয়ে রেখে এগোল গেটের দিকে।
কাঠের একটা কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক, পরনে খাকি ইউনিশ্চম। পুলিশ নয়, সিকিউরিটি গার্ড গোছের কিছু হবে, আন্দাজ করল মুসা। কাঁটাতারের পা খুলে দিল গার্ড, ভেতরে ঢুকল হ্যারিকিরি। আবার পাল্লা লাগিয়ে তালা আটকে দিল গার্ড।
গাড়ির শব্দে ফিরে তাকাল মুসা, বড় রাস্তা ধরে ছুটে আসছে একটা পিকাপ। আরও ঘন ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেল সে, যাতে গাড়ির লোকের চোখে না পড়ে। মো নিয়ে সরু রাস্তায় নেমে কাঁটাতারের বেড়ার দিকে এগুলো পিকআপটা। পার্কিং লটে থামল। সামনে থেকে নামল দুজন, পেছন থেকে দুজন, চারজনই জাপানী। সবার হাতেই একটা করে লাঞ্চবক্স। এগিয়ে গেল গেটের দিকে।
তালা খুলে চারজনকেই ভেতরে ঢুকতে দিল গার্ড।
কি ধরনের এলাকা এটা?—অবাক লাগছে মুসার। এত কড়াকড়ি কেন? কয়েকটা কাঠের কুঁড়ে ছাড়া আর তেমন কিছু তো চোখে পড়ছে না। কুঁড়েগুলোর পরে বেশ অনেকখানি ছড়ানো সমভূমি সাগরে গিয়ে মিশেছে। কোন গাছপালাও দেখা যাচ্ছে না ওখানে।
আরে না, সমভূমি তো নয়, ভালমত লক্ষ্য করতেই বুঝল মুসা। বিশাল এক কৃত্রিম হ্রদ, খুদে উপসাগরও বলা চলে। খাল কেটে সাগরের পানি ঢোকার ব্যবস্থা হয়েছে, খালে পাথরের নিচ বধ। সুদের পানির কয়েক ইঞ্চি ওপরে কাঠের অনেকগুলো সাঁকো, একটার ওপর আরেকটা আড়াআড়ি ফেলে তৈরি হয়েছে অণতি চারকোণা খোপ, অনেক ওপর থেকে দেখলে মনে হবে চেককাটা বিছানার চাঁদরের মত।
ওই সাঁকোতে উঠল গিয়ে জাপানীরা, একেকদিকে ছড়িয়ে পড়ল। খোপের কিনারে উবু হয়ে বসে টেনে তুলল দড়িতে বাধা খাঁচা, একের পর এক। খাঁচায় কি আছে, দেখতে পাচ্ছে না মুসা, তবে জাপানীরা যে গভীর আগ্রহে দেখছে, এটা বোঝা যাচ্ছে। খাঁচার ভেতর থেকে কিছু বের করছে ওরা, তারপর কিছু একটা করছে।
হ্যারিকিরিকে চেনা যাচ্ছে না এখান থেকে, তবে ওই পাঁচজনেরই কোন একজন সে, তাতে সন্দেহ নেই।
আধ ঘণ্টা ঝোপের ভেতর পড়ে রইল মুসা, কিছুই ঘটল না। কিছুই বদলাল। বেড়ার ভেতরে তিনজন গার্ড দেখা যাচ্ছে, টহল দিচ্ছে। জাপানীরা তাদের খাঁচা নিয়ে ব্যস্ত। খানিক পর পর একটা করে খাঁচা নামিয়ে দিয়ে নতুন আরেকটা টেনে তুলছে।
ওদের মাথার ওপর ঘনঘন চক্কর দিচ্ছে সীগাল আর পায়রার ঝক। এটা স্বাভাবিক দৃশ্য। এদিককার উপকূলে ওই পাখি না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক।