অপেক্ষা করছিল ব্লিংকি।
হুঁ, মাথা দোলাল মুসা, পরিষ্কার হচ্ছে।
রবিনের সৌজন্যে জেনেছি, কেন অপেক্ষা করছিল ব্লিংকি, আর কেনই বা ছুটে গিয়েছিল সবুজ ভ্যানকে অনুসরণ করার জন্যে।
আমার সৌজন্যে? ভুরু কোচকাল রবিন।
হ্যাঁ, তাই তো। তুমিই তো দেখে এসেছ, হ্যারিকিরির ডাকবাক্সে নতুন রঙ করা হয়েছে, তারমানে নতুন বাড়ি বদলেছে জাপানীটা। এটাই জানতে চেয়েছিল রিংকি কোথায় নতুন বাড়ি নিয়েছে হ্যারিকিরি।
কেন?
সেটাই জানতে হবে আমাদের। হ্যারিকিরির সঙ্গে ব্লিংকির কি সম্পর্ক, আর মুক্তোরই বা কি সম্পর্ক।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল কিশোর, সবুজ ভ্যানটাকে আবার অনুসরণ করতে হবে আমাদের। জানার এটাই একমাত্র উপায়।
বীপার তো লাগানোই আছে, বলল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর। এটা দিয়ে আর কাজ হবে না। নিশ্চয় এতক্ষণে ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে। হ্যারিকিরির বাড়ি গিয়ে ব্যাটারি বদলে দিয়ে আসা খুব ঝুঁকির ব্যাপার।
তাহলে?
কাজটা তোমাকেই করতে হবে, মুসা, গোয়েন্দা-সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা। দু-হাত নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এই ভয়ই করছিলাম। কপালই খারাপ। যত কঠিন আর ঝুঁকির কাজ, সব এই মুসা আমানের ঘাড়ে। কি আর করব, মাথায় তো আমারই সইবে,চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
তা জনাব, কাজটা কি?
নিষ্ঠুর! চেঁচিয়ে উঠল তোতা। নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর!
দূর ব্যাটা! তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা। চুপ থাক!
তোতাটাও বল, দৃর ব্যাটা! চুপ থাক!
১০
পরদিন খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়ল মুসা। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে জনসের প্যান্ট পরে নিল। ধূসর সোয়েটার গায়ে দিল। তারপর মীকার পায়ে দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে এল নিচে, রান্নাঘরে, যা-ই পাওয়া যায় কিছু মুখে দিয়ে বেরোবে।
রান্নাঘরের টেবিলে পড়ে আছে একটা কালো সানগ্লাস, গতরাতে নিশ্চয় তার বাবা ফেলে গেছেন। চশমাটা নেবে কি নেবে না তবতে ভাবতেই গিয়ে ফ্রিজ খুলল। ঠাণ্ডা কেক ছাড়া আর কিছু নেই, তা-ই বের করে নিল গোটা দুয়েক, তারপর একটা গ্লাসে দুধ ঢেলে নিয়ে এসে বসল টেবিলে।
চশমা পরলে কি তার চেহারা বদলে যাবে? তাকে দেখলে তখন চিনতে পারবে হ্যারিকিরি?
চশমাটা নেবে ঠিক করল মুসা। দরকার হলে পরতে পারবে। খাপসুদ্ধ চশমাটা নিয়ে বেরিয়ে এল সে। ছাউনির তলায় রাখা আছে দুটো সাইকেল। তার মধ্যে। একটা দশ গীয়ারের ইংলিশ রেসার, মুসার খুব প্রিয়, গত জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছেন। সাইকেলটাকে খুব যত্ন করে সে। পুরানো সাধারণ সাইকেলটা সব সময় ব্যবহার করে, অন্যটা বের করে বিশেষ দরকার পড়লে। ঘণ্টায় তিরিশ মাইল গতিতে সহজেই চলতে পারে ইংলিশ রেসার, সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় চল্লিশ।
আদর করে সাইকেলটার গায়ে চাপড় দিল মুসা, ঘোড়াপ্রেমিক যেমন তার প্রিয় ঘোড়ার গায়ে চাপড় দেয়। ছাউনি থেকে বের করে চড়ে বসল।
দশ মিনিটেই পৌঁছে গেল লিট টোকিওর সীমান্তে। রাস্তার ধারে গাছপালার আড়ালে সাইকেলটা পার্ক করে একটা শেকড়ে বসল সে, চোখ রাখল হ্যারিকিরির বাড়ির দিকে।
ঠিক সময়েই এসেছে মনে হচ্ছে। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ড্যান, পোটিকোয় আলো জ্বলছে।
পুব পাহাড়ের মাথায় সবে উঁকি দিয়েছে সূর্য, এই সময় নীল একটা সেডান এসে থামল বাড়ির সামনে। একজন লোক নেমে হেঁটে গেল গাড়িবারান্দার দিকে। কালো কোট, ডোরাকাটা প্যান্ট, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, নোকটা রিচার্ড হ্যারিস ছাড়া আর কেউ না, মুসা শিওর। আলো খুব স্পষ্ট নয়, কিন্তু এতবার এই পোশাকে দেখেছে লোকটাকে, ভুল হতে পারে না তার।
কালো চশমা পরেনি হ্যারিস, হাতে একটা বাক্সমত জিনিস, সম্ভবত খবরের কাগজ মোড়া। ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে প্যাকেটটা ভেতরে রাখল সে।
পোটিকোর আলো নিভে গেল।
ভ্যানের দরজা বন্ধ করে ফিরে এল হ্যারিস, সবুজ গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
আবার গাছে হেলান দিল মুসা। মিনিট দশেক পর হ্যারিকিরির বাড়ি থেকে একজন জাপানী বেরিয়ে সবুজ ভ্যানের দিকে এগোল।
রবিনের মতই দ্বিধায় পড়ল মুসা, কে লোকটা? হ্যারিকিরি না তার সঙ্গী দোভাষী সেই জাপানী?
মনে পড়ল, কিশোর বলেছে, দোভাষীর পরনে ছিল চওড়া বেল্ট, জীনসের প্যান্টে গ্রীজের দাগ। ভালমত দেখল মুসা, কিন্তু বেল্ট পরেনি এলাকটা, প্যান্টেও দাগ নেই। তারমানে, হ্যারিকিরি। মোটা সুতার রঙ চটা পোশাক পরেছে, হাতে একটা ধাতব বাক্স, লাঞ্চ বক্স।
গাছের আড়াল থেকে সাইকেল বের করে পিছু নেয়ার জন্যে তৈরি হলো মুসা।
পেছনের দরজা খুলল না হ্যারিকিরি, এমনকি পেছনের জানালা দিয়ে ভেতরেও চেয়ে দেখল না। ড্রাইভিং সীটে উঠে এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গাড়ি পিছিয়ে বের করে আনতে শুরু করল।
রাস্তায় সাইকেল মামাল মুসা।
গাড়ি পথের শেষ মাথায় এসে ডানে মোড় নিল ভ্যান, তারপর সোজা ছুটে এল মুসার দিকে। এটা আশা করেনি সে, তাড়াতাড়ি সাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ল আবার গাছের আড়ালে।
সাঁ করে ছুটে চলে গেল ভ্যান।
আস্তে আস্তে দশ পর্যন্ত গুণল মুসা, তারপর গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পিছু নিল গাড়ির।
পাহাড়ী পথ ধরে শহরের দিকে ছুটে চলেছে ভ্যান, অনুসরণ করতে কোনই অসুবিধে হলো না মুসার। মেইন স্ট্রীটে পড়ে আরও সুবিধে হয়ে গেল, একটা নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পিছে পিছে চলল সে।