অবশেষে বনের ধারে ঘাসে ঢাকা ছোট একটা খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। আশ্চর্য নীরবতা এখানে। কোলাহলকারী পাখিরা যেন এড়িয়ে চলে জায়গাটাকে, ওদের কলরব অনেক পেছনে।
শুকনো জায়গা দেখে বসে পড়ল কিশোর। হাঁপিয়ে উঠেছে, জিরিয়ে নেবে।
মুসা পা ছড়িয়ে বসল তার পাশে। খানিকদূরে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসল রবিন!
প্রায় মিনিট পাঁচেক গেল। একটা রবিন এসে বসেছে তাদের কয়েক গজ সামনে, ভেজা মাটি থেকে ঠুকরে কেঁচো বের করে খাচ্ছে। আনমনে পাখিটাকে দেখছে মুসা।
নাহ, এবার ওঠা দরকার। উঠতে যাবে কিশোর, এই সময় একসঙ্গে তিনটে ঘটনা ঘটল, চোখের পলকে।
আঙ্কে চিৎকার দিয়ে তোতাটা উড়ে গেল মুসার কাঁধ থেকে। মাথা তুলে আকাশের দিকে চেনেই চমকে গেল রবিনটা। কালে! একটা ছায়া পাথরের মত এসে পড়ল তার ওপর। পালানোর কোন সুযোগই পেল না পাখিটা। ভয়ানক এক শিকারী বাজ নাপিয়ে পড়েছে। ধারাল নখ আর ঠোঁট দিয়ে টেনে টেনে রবিনের শরীরটা নিমেষে ছিড়ে ফেলে, যা যা খাওয়ার বের করে নিল বাজ। মাংসটা নখে ঝুলিয়ে নিয়ে উড়ে চলে গেল রকেটের মত। মাটিতে পড়ে রইল শুধু রবিনের মাথা, পা দুটো আর কয়েকটা রক্তাক্ত পালক।
পুরো এক মিনিট কোনও কথা বলতে পারল না তিন কিশোর। ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেছে যেন ওরা।
গাছের ডাল থেকে ফিরে এসে আবার মুসার কাঁধে বসল তোতাটা। নিষ্ঠুর! চেঁচিয়ে উঠল তীক্ষ্ণ স্বরে। নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর!
ঠিকই বলেছিস, পাখিটার সঙ্গে একমত হলো কিশোর। তবে রবিনটা জীবন দিয়ে জানিয়ে দিয়ে গেল আমাদের, দুআঙুলে পায়রাটাকে কে খুন করেছে।
এবং কেন বাজ মারছে কেউ,যোগ করল রবিন। রেসিং হোমারদের খুন করে বলেই তো বাজ মারে, নাকি?
হ্যাঁ, পকেট থেকে কাগজে মোড়া চুলের বলটা বের করল কিশোর। মোড়ক খুলে তাকাল। কিন্তু কে বিষ খাওয়াচ্ছে জানি না এখনও। হীরাকে পিটিয়ে মেরেছে কে, তা-ও জানি না। উঠে দাঁড়াল সে। পায়ের ছাপ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে, মাটি জায়গায় জায়গায় এখনও ভেজা, ছাপ থাকতে বাধ্য। আমরা খুঁজে পাইনি, কিন্তু আছেই। আকাশের দিকে তাকাল। এসো, যাই। আরও. এক ঘণ্টা আলো থাকবে। এবার ভাগ হয়ে তিন দিকে চলে যাব, ছড়িয়ে পড়ে খুঁজব। মুসা, তুমি এদিকে যাও, রবিন তুমি ওদিকে। মাটিতে প্রতিটা ইঞ্চি দেখবে, বিশেষ করে কাদামাটি যেখানে আছে।
কিছু দেখলে কিভাবে জানাব? জিজ্ঞেস করল রবিন। কি সঙ্কেত?
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর। জোরে জোরে গাইবে।
দি হাইমস অভ দা ব্যাটল?
না। অন্য সুর। এসো, আমার সঙ্গে সঙ্গে গাও। আমার সোনার বাংলা…
কিশোরের সঙ্গে সঙ্গে বার কয়েক গেয়ে প্র্যাকটিস করে নিল মুসা আর রবিন। তারপর নিজে নিজে গাইল, কিশোরের চেয়ে গলা ডাল দুজনেরই, রবিন তো মৎকার গাইল।
পায়ের ছাপ খোঁজার জন্যে তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ল ওরা। মুসা জে পেল, মিনিট পনেরো পরে। সরু পথ ধরে এগিয়ে গেছে একজোড়া বুটের ছাপ, ভেজা নরম মাটিতে বেশ গভীর হয়ে বসেছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। মলে নিভে আসছে দ্রুত! রাতের সাড়া পেয়েই কলরব কমিয়ে দিয়েছে পাখির দল, শব্দ এখন অনে? কম। আবছা অন্ধকার বনপথ দাঁড়িয়ে অকারণেই গা ছমছম করে উঠল মুসার। ভয়ে ভয়ে তাকল চারদিকে, মাথায় ডাণ্ডা মারতে আসছে ন-তে আবার কেউ?
গান গাওয়ার জন্যে মুখ খুলল মুসা।
কিন্তু সুর ভুলে গেছে। অথচ তখন বেশ গেয়েছিল, এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেল? গেছে, কি আর করবে। চেষ্টা করল, আ-আমার সোনার দূর হচ্ছে না। আবার চেষ্টা করল। হলো না।
আমার সোনার বাংলা, গেয়ে উঠা কাঁধে বসা তোতাটা, চমৎকার শিখে নিয়েছে, সুরও বেশ হয়েছে।
ধন্যবাদ, তোতামিয়া, হেসে আলতো চাপড় দিয়ে পাখিটাকে আদর করা মুসা। সাধনা করলে ওস্তাদ হতে পারতে। গলা চড়িয়ে গাইল, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
কাছাকাছিই রয়েছে কিশোর আর রবিন, সাড়া মিলল সঙ্গে সঙ্গেই।
মিনিটখানেক পরই আবার একসাথ হলো তিনজনে।
গভীর মনোযোগে বুটের ছাপগুলো দেখল কিশোর। পকেট থেকে আবার বের করল চুলের বল। তাড়াতাড়িই পেয়েছ, মুসা, গুড। এগুলো হ্যারিসের নয়। গতকাল ওর সঙ্গে লাস্থ করার সময় ভালমত দেখেছি ওর জুতো। অনেক ছোট পা, জুতোর নাক ভোঁতা। সুতরাং, চুলের বনটার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা হ্যারিসের দাড়ি নয়। কাটা ঝোপে আটকে তার দাড়ি ছেড়েনি, যেটা খেলার সময় পেয়ে গিয়ে বল বানিয়েছে পান্না।
আপাতত আর কিছু দেখার নেই। বন থেকে বেরিয়ে এল ওরা, যেখানে সাইকেল রেখেছে সেখানে।
দোতলায় মিস কারমাইকেলের শোবার ঘরে আলো জ্বলছে। কিশোর অনুমান করল, তিনি শুয়ে পড়েছেন, ঘুমিয়ে শোক ভুলতে চাইছেন।
তাঁকে জানানোর মত এখনও কিছু আবিষ্কার করিনি আমরা, কারও উদ্দেশে কথাগুলো বলছে না কিশোর। যা জানি, শুধুই অনুমান।
রংকির পায়ের ছাপ সন্দেহ করছ? রবিনের মনে পড়েছে, কিশোর বলেছিল, স্ন্যাকস রেস্টুরেন্টে চোখা মাথাওয়ালা বুট পরা ছিল সেটারের পায়ে।
তাকে পয়লা সন্দেহ, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কিশোর। দ্বিতীয় সন্দেহ হারিকিরি। আমার ধারণা, সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি ওই জাপানীটা।
কেন? জানতে চাইল মুসা।
মেসেজটা হ্যারিকিরিই লিখেছে : আজ মুক্তো নেই, এক আঙুল তুলল কিশোর। দুই আঙুল তুলে বলল, লিটুল টোকিওয় হ্যারিকিরির বাড়িতেই গিয়েছিল রিচার্ড হ্যারিস। তিন আঙুল তুলল, আর স্ন্যাকস রেস্টুরেন্টে হ্যারিকিরির জন্যেই