আজ আর রাত করবে না, ভাবল কিশোর। কাজ শেষ করে রাতের আগেই ফিরে যাবে। কে জানে, আজ কি নিয়ে বোপের ভেতর অপেক্ষা করছে রিচার্ড হ্যারিস। হয়তো ইয়া বড় এক রাম দা। ঘাড়টা নাগালে পেলেই দেবে কোপ মেরে।
বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন মিস কারমাইকেল। কালো মখমলের লম্বা হাতাওয়ালা পোশাক পরেছেন, শোক প্রকাশের জন্যে। বার বার রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন। ছেলেদেরকে নিয়ে এলেন সাউণ্ড ঘরে।
দেখো, আর কিছুই বলতে পারলেন না, কষ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। শুধু হাত তুলে দেখিয়ে দিলেন টেবিলের দিকে।
সাদা কাপড়ের ওপর পড়ে আছে আরেকটা বাজ পাখি।
টেবিলের দিকে এগোচ্ছে মুসা, কি মনে করে মিস কারমাইকেলের কাধ থেকে উড়ে এসে মুসার মাথার ওপর এক মুহূর্ত ফড়ফড় করল তোতাটা, তারপর কাঁধে বসে পড়ল।
কি নিষ্ঠুর! রীতিমত ফেঁপাচ্ছেন এখন মিস কারমাইকেল।
নিষ্ঠুর! প্রতিধ্বনি করল তোতাটা। নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর!
মরা বাজটাকে পরীক্ষা করে দেখল কিশোর। আঘাতের কোন চিহ্ন নেই। অন্য বাজটার মত এটাকেও বোধহয় বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে।
কখন পেয়েছেন এটা? জিজ্ঞেস করল সে।
সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেন মিস কারমাইকেল, ফেঁপানী বন্ধ হয়েছে, তবে বার বার রুমাল দিয়ে চোখ মোছা থামেনি। এই তো, খানিক আগে।
কোথায়?
আগের জায়গায়, ঢোক গিললেন, আঙুল বোলালেন মুক্তার হারে। স্টীলকে যেখানে পেয়েছিলাম সেখানেই।
বাজের খাবার যেখানে রেখে আসেন?
নীরবে মাথা ঝোঁকালেন মিস কারমাইকেল।
মহিলার অবস্থা দেখে খারাপই লাগছে কিশোরের, সহানুভূতি জানিয়ে বলল, আপনার এখন মনের অবস্থা কেমন, বুঝতে পারছি। তবু দয়া করে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব যদি দেন…
নীরবে মাথা কাত করলেন মিস কারমাইকেল। মুক্তার হারে আঙুল বুলিয়েই চলেছেন, বোধহয় বেদনা কিছুটা লাঘব হচ্ছে এতে।
চেষ্টা করব, বললেন তিনি।
আগের বার যখন এসেছিলাম, বলল কিশোর, আপনার পোষা দোয়েল, হীরা… থেমে গেল সে, আবার না পুরানো শোক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মহিলার, কেঁদে ফেলেন, তাহলে তার প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আর আশা নেই।
কিন্তু কাঁদলেন না মিস কারমাইকেল, মাথা ঝাকালেন শুধু। আপনি বলেছেন, পাখিটা নাকি নানারকম জিনিস কুড়িয়ে আনার ওস্তাদ ছিল।
মুক্তো, প্রিয় অতীতের কথা মনে করে মলিন হাসি ফুটল মিস কারমাইকেলের ঠোঁটে। তিন তিনটে মুক্তো এনে দিয়েছিল আমাকে।
বলেছিলেন, দুটো দোয়েল আছে আপনার। আরেকটার নাম কি?
পান্না।
সে-ও কি জিনিস এনে দেয়?
মাঝেমধ্যে, রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন মিস কারমাইকেল, আর কাঁদবেন না স্থির করেছেন বোধহয়, কিন্তু হীরার তুলনায় পান্না কোন কাজেরই না। যত সব অকাজের জিনিস কোখেকে গিয়ে নিয়ে আসে, একেবারেই বাজে।
মরা বাজটার দিকে চেয়ে আনমনে ঠোঁট কামড়াচ্ছে কিশোর। কখনও কোন মেসেজ এনে দিয়েছে?
মেসেজ?
এই, কাগজের টুকরো। তাতে লেখা-টেখা কিছু?
না আনেনি। তেমন কিছু কখনও আনলে মনে থাকত। এই তো, আজ সকালে দেখো না, কি এনেছে। দেখতে চাও?
অবশ্যই দেখতে চায়, জানাল কিশোর।
সাইড টেবিলের ওপর থেকে একটা কাঁচের অ্যাশট্রে নিয়ে এলেন মিস কারমাইকেল। বাড়িয়ে ধরলেন কিশোরের দিকে।
দেখল কিশোর। চুল দিয়ে পাকানো খুদে একটা বল। হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল সে। খসখসে, কালো কোঁকড়ানো চুল দিয়ে তৈরি। দোয়েল পাখির আজব খেয়াল, অনেক সময় নিয়ে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আশ্চর্য নৈপুণ্যে বানিয়েছে বলটা। মিস কারমাইকেলের অনুমতি নিয়ে যত্ন করে বলটা পকেটে রেখে দিল কিশোর। আচ্ছা, কোথায় পেয়েছে এটা, বলতে পারবেন?
না, অ্যাশট্রেটা আবার আগের জায়গায় রেখে এলেন মিস কারমাইকেল। হীরা ও মুক্তোগুলো কোথেকে এনেছিল, জানি না।
জানালার বাইরে তাকাল কিশোর। বেলা শেষ, তবে আঁধার হতে এখনও ঘণ্টা দুই বাকি। মুসা আর রবিনকে বলল, চলো যাই, আরেকবার ঘুরে দেখিগে বাগানে। মিস কারমাইকেলের দিকে ফিরল, আপনার আপত্তি নেই তো?
না না, আপত্তি থাকবে কেন? তোমরা যা করছ আমার জন্যে, কে কার জন্যে করে? মিস্টার হ্যারিসের কাছেও আমি ঋণী। কিন্তু বাবা, কিছু মনে কোরো না, আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারছি না। সইতে পারব না, রুমাল রে করলেন তিনি।
আবার যদি কিছু দেখি… গলা কেঁপে উঠল তার।
ঠিক আছে ঠিক আছে, আপনি থাকুন, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল কিশোর।
বিশাল জানালা দিয়ে কোলাহলের মধ্যে বেরিয়ে এল ওরা। তোতাটা বসে আছে মুসার কাঁধে। ওদের সঙ্গে বাগানে ঘোরার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি। মুসা থাকতে দিল পাখিটাকে, টমের মতই তোতাটাকেও পছন্দ হয়েছে তার।
লনের প্রান্তে খোয়া বিছানো পথের ধারে এসে থামল ওরা। খানিক দূরে গাছ, যেটার তলায় মরে পড়ে ছিল দুটো বাজপাখি। আজ জায়গাটা পরিষ্কার। মাংসের টুকরো পড়ে নেই, পায়ের ছাপ নেই।
চলো, বনের দিকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলল কিশোর, আলাদা হওয়ার দরকার নেই। এক সঙ্গে যাই।
সেটাই ভাল, গলা ফাটিয়ে জবাব দিল মুসা। রিচার্ড হ্যারিসের লাঠির বাড়ি খেতে চাই না। তার মেজাজ আজ ভাল না মন্দ কে জানে।
এক ঘণ্টা ধরে ঘোরাঘুরি করল তিন গোয়েন্দা, বনের ভেতর, ঝোপের ধারে, সরু পথে। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি নরম হয়ে আছে কোথাও কোথাও। আজ আর কারও সঙ্গেই সাক্ষাৎ হলো না।