রকি বীচের উত্তর-পশ্চিমে নিচু পাহাড়শ্রেণীর ঢালের গায়ে আর পাদদেশে বেশ কিছু বাড়িঘর আছে। জায়গাটা লিটল টোকিও নামে পরিচিত, রকি বীচের জাপানী পল্লী।
লিটল টোকিওর সীমানায় পৌঁছেই আবার থামার নির্দেশ দিল কিশোর। শখানেক গজ দূরে একটা একতলা বাড়ির গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ভ্যান।
পথের ধারে সাইকেল রাখল তিন গোয়েন্দা, গাছের সারির আড়ালে লুকিয়ে চোখ রাখল বাড়িটার ওপর।
হ্যারিকিরির বাড়ি নাকি? বলল মুসা।
জবাব দিল না কিশোর। ভ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।
গাড়িবারান্দায় একজন লোক, গাড়িটার পাশ কাটিয়ে আসছে। বাড়ির ভেতরে থেকেই বেরিয়েছে মনে হয়। রাস্তায় এসে নামল লোকটা। আরেকটা লাল গাড়ি পার্ক করা ওখানে, তাতে চড়ে চলে গেল।
হ্যারিকিরি? শিওর হতে পারছে না রবিন। সব জাপানীর চেহারাই এক রকম লাগে তার কাছে।
না, মাথা নাড়ল কিশোর, তার সঙ্গী।
কিশোরের দৃষ্টিশক্তির ওপর পুরো আস্থা রয়েছে রবিনের, তবু জিজ্ঞেস না করে পারল না, কি করে বুঝলে?
সহজ। ওর হাঁটা, ওর চোখ, ওর কান। কেন, আরেকটা জিনিস খেয়াল করোনি? কোমরের কেষ্ট…আর প্যান্টে লেগে থাকা গ্রিজের দাগ?
খেয়াল করেনি রবিন। অতি সাধারণ জিনিস বলেই।
তাহলে, ধরে নিতে অসুবিধে নেই, ওটা হ্যারিকিরিরই বাড়ি, বিড়বিড় করল কিশোর, কিন্তু এই ধরে নেয়ার ব্যাপারটায় মোটেই সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। শিওর হওয়া দরকার। ডাকবাক্সটায় নাম দেখলে বোঝা যাবে কার বাড়ি।
ডাকবাক্স দেখতে হলে বাড়ির কাছে যেতে হবে। বাক্সটা এপাশে আছে না ওপাশে, বলা যাচ্ছে না, ওপাশে থাকলে বাড়ির পাশ কাটিয়ে যেতে হবে।
রবিন তুমি যাও, বলল কিশোর। মুসা বেশি লম্বা। আমারও চুল বেশি কোঁকড়া, দূর থেকেই চোখে পড়ব দুজনে। জানালার কাছে যদি হ্যারিকিরি থাকে, সহজেই আমাদের চিনে ফেলবে। তোমার উইণ্ডচীটারটা খুলে চুলগুলো এলোমেলো করে নাও। আর দশজন আমেরিকান ছেলের সঙ্গে তোমার তফাত বুঝতে পারবে না সে, তুমি যেমন জাপানীদের আলাদা করে চিনতে পারো না।
ও-কে, আর দশটা সাধারণ ছেলের মতই দেখতে, জেনে খারাপ লাগছে রবিনের। তবে সে চোখে পড়ার মত নয় বলে গোয়েন্দাগিরিতে উন্নতি করতে পারবে ভেবে ভালও লাগছে। চিয়াত করে চেন টেনে উইচীটার খুলে কিশোরের হাতে দিয়ে রওনা হলো রবিন।
গাড়িবারান্দার ধারেই রয়েছে সাদা রঙ করা ডাকবাক্স। দেখেও থামল না রবিন, সোজা হেঁটে গেল আরও খানিকটা যেন এখানকার কোন কিছুর প্রতি কোন আগ্রহই নেই তার-তারপর থেমে ফিরে তাকাল।
লেখা রয়েছে : এম হারিকিরি।
সাদা বাক্সে উজ্জল কালো কালিতে লেখা অক্ষরগুলো ফুটে রয়েছে। পড়তে কোন অসুবিধে হলো না। ঘুরে আবার পা বাড়াতে যাবে, এই সময়েই জাগল সন্দেহটা। মনে হলো, হ্যারিকিরির আগে আরেকটা নাম লেখা ছিল ঠিক ওই জায়গাটাতেই।
নিশ্চিত হতে হলে ভালমত দেখা দরকার। তার জন্যে আরও কাছে যেতে হবে। ঝুঁকিটা নেবে সে ঠিক করল।
ঠিকই সন্দেহ করেছে রবিন। সাদা রঙের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে আগের লেখা, তবে তেমন যত্ম নেয়নি, নইলে চোখে পড়ত না। কখন রঙ করা হয়েছে? সতর্ক দৃষ্টিতে বাড়ির দিকে তাকাল সে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আরও এগোল, চলে এল বাক্সের একেবারে কাছে। ছুঁয়ে দেখল, আঠা আঠা লাগে। হুঁ, বেশিক্ষণ হয়নি, তাই এমন চকচকে। বাড়িও কি এই কিছুক্ষণ আগে বদলাল নাকি হারিকিরি?
কাজের কাজ করেছি একটা, নিজের প্রশংসা না করে পারল না রবিন। কিশোরও এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারত কিনা সন্দেহ। বন্ধুদেরকে খবরটা জানানোর জন্যে তাড়াতাড়ি ঘুরে রওনা হলো সে।
দুই কদম এগিয়েই শব্দ শুনে ফিরে তাকাল রবিন, স্থির হয়ে গেল পাথরের মত। গাড়িবারান্দার ওপার থেকে আসছে একজন লোক। বেঁটে, কালো কোট গায়ে, ডোরাকাটা প্যান্ট, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। কালো চশমা নেই এখন চোখে।
এই ছেলে, শোনো, এই, ডাকল রিচার্ড হ্যারিস।
দৌড়ে পালাতে চাইল রবিন। পারল না। পা কথা শুনছে না। অনেক সময় দুঃস্বপ্নে যেমন প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হাত-পা নাড়ানো যায় না, অনেকটা যেন সেই রকম।
কাছে এসে দাঁড়াল হ্যারিস। লোকটার হাতে লাঠি নেই, কিন্তু তাতে কি? পকেটে পিস্তল তো থাকতে পারে।
ভালই হলো, বলল হ্যারিস, তোমাদেরকেই খুজছি মনে মনে।
ঠোঁট ভালমত দেখা যায় না, ফলে হাসছে কি না বোঝা গেল না। তবে চোখ দুটো আন্তরিকতা মাথানো বলে মনে হলো রবিনের।
অন্যেরা কোথায়? তোমার বন্ধুরা?
ভেবেছিল হাতও নড়াতে পারবে না, কিন্তু পারল, হাত তুলে দেখাল রবিন রাস্তার দিকে। হ্যারিসকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
সাইকেলের হ্যান্ডেলে বাধা ট্র্যাকারটা রবিনের উইণ্ডচীটার দিয়ে ঢেকে দিয়েছে কিশোর।
লিটল টোকিওতে প্রায়ই আসো তোমরা? জিজ্ঞেস করল হ্যারিস।
জাপানী রেস্টুরেন্টে খেতে আসি, জবাব দিল কিশোর। জাপানী খাবার মুসার খুব পছন্দ।
হ্যাঁ, ভাল খাবার। বিশেষ করে ফুজিয়ামা, আমিও যাই মাঝেমধ্যে, বলল হ্যারিস। হাসল কিনা বুঝতে পারল না রবিন। চলো না আজও যাই। আমি লাঞ্চ খাওয়াব তোমাদের?
দ্বিধা করছে কিশোর, কি জবাব দেবে? শেষবার যখন হ্যারিসের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছিল। তার আগের বার লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই লোকই এখন লাঞ্চের দাওয়াত দিচ্ছে, ঘটনাটা কি?