দুই লাফে এগিয়ে গিয়ে প্রথম লোকটার বাহুতে হাত রাখল কিশোর। আমি তো আপনার কথার জবাব দিলাম, এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন, প্লীজ?
এইবার লোকটার ভাবনার পালা। ডেকে নিয়ে বলল, কি প্রশ্ন?
মেসেজে লেখা ছিল : আজ মুক্তো নেই। মিস্টার টিসুশিতা অনুবাদ করে তো তাই বললেন।
হ্যাঁ।
আড়চোখে রবিনের হাতের দিকে তাকাল কিশোর, ছোট্ট যন্ত্রটা আছে। লোকটার দিকে ফিরে বলল, এর মানে কি? বোকার অভিনয় খুব ভাল করতে পারে কিশোর, এ-মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে তার মত হাঁদারাম, মাথামোটা ছেলে দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। কিসের মুক্তো, কিসের আজ? বোকার মতই হাত নাড়ল সে।
হ্যারিকিরির দিকে তাকাল লোকটা, এই সুযোগে পাশে দাঁড়ানো রবিনের গায়ে খোচা দিয়ে ইঙ্গিত করল কিশোর।
ফিরল লোকটা, হাসল। খুব সহজ। আমার বন্ধু হ্যারিকিরি তরকারির চাষ করে। খেত আছে। জাপানী পাড়ায় বাজারে বিক্রি করে সেই তরকারি। খেতগুলো বাজার থেকে দূরে, উপকূলের কাছে। দোকানদাররা জানতে চায়, কি তরকারি আছে তার কাছে…
হাঁ করে আছে কিশোর, বোকা বোকা দৃষ্টিতে সামান্যতম পরিবর্তন নেই। চোখের কোণ দিয়ে দেখছে, ভ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রবিন।
পৌঁছল রবিন। পেছনের বাম্পারের কাছে দাঁড়িয়ে চট করে একবার নিচু হয়েই সোজা হলো।
…কাজেই খবর জানাতে হয় হ্যারিকিরিকে, বলে যাচ্ছে লোকটা। কবুতর দিয়ে মেসেজ পাঠাতে পয়সা লাগে না, তাছাড়া তাড়াতাড়িও হয়, তাই পুরানো পদ্ধতিই বেছে নিয়েছে আমার বন্ধু। লিখে দেয়? আজ শালগম আসছে, আজ বাঁধাকপি কিংবা গাজর।
হাত নাড়ল রবিন। দু-হাতের মুঠোই খোলা, তারমানে কাজ হয়ে গেছে।
তাই নাকি? খুব অবাক হয়েছে কিশোর। আপনার বন্ধু কি মুক্তোও কলায় নাকি? ওগুলো সজি না ফল?
জোরে হেসে উঠল লোকটা। মনে মনে আস্ত গর্দভ ভারছে কিশোরকে, বুঝল কিশোর। মুক্তো সব্জিও না, ফলও না। সাগরে হয়, বিনিকের পেটে, একধরনের মুল্যবান পাথর। আমার বন্ধু যে মুক্তোর কথা লিখেছে, সেটা পেঁয়াজ। মুক্তোপেঁয়াজ বলে।
অ। থ্যাংক ইউ, বলল কিশোর। আপনার কাছে অনেক কিছু জানা গেল।
কিশোরকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল লোকটা। তার পাশে কল হ্যারিকিরি। স্টার্ট নিল এঞ্জিন।
গাড়িটা মোড়ের কাছে পৌঁছতেই লাফিয়ে উঠল কিশোর। রবিন, জলদি, ট্র্যাকারটা।
বুদ্ধি করে নিয়েই এসেছে রবিন, গেটের ভেতরে এক জায়গায় রেখে এসেছে। এক ছুটে গিয়ে নিয়ে এল। ছোট একটা বাক্স মত, তাতে অ্যান্টেনা লাগানো। পুরানো আমলের একটা রেডিওকে পরিবর্তন করে বীপারের সিগন্যাল ধরার যন্ত্র বানিয়েছে কিশোর। সুইচ টিপে ডায়াল ঘেরাল সে।
বীপ। বীপ। বীপ।
সম্পষ্ট শব্দ ভেসে এল যন্ত্রটার স্পীকারে। কাজ করছে ভ্যানের বাম্পারে লাগানো বীপার, চুম্বকের সাহায্যে ওটাকে আটকে দিয়েছে রবিন।
অ্যান্টেনাটা দক্ষিণে ঘোরাল কিশোর।
আরও স্পষ্ট হলো বীপ-বীপ।
উপকূলের দিকে যাচ্ছে, বলল কিশোর। চলো, আমরাও যাই।
বলতে হয়নি, ইতিমধ্যেই এক এক করে তিনটে সাইকেল গেটের বাইরে নিয়ে এসেছে মুসা।
দ্রুত প্যাডাল ঘুরিয়ে চলেছে ওরা। নিজের সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে ট্র্যাকারটা বেঁধে নিয়েছে কিশোর। এক হাতে হ্যাণ্ডেল ধরেছে, আরেক হাতে অ্যান্টেনার মাথা ঘোরাচ্ছে এদিক ওদিক। শব্দের কম-বেশি শুনে অনুমান করছে, কোনদিকে গেছে। ভ্যান।
গাড়ির খুব বেশি কাছে যাওয়ার দরকার নেই, এক মাইল দূর থেকেও সঙ্কেত দেবে বীপারটা। সহজেই অনুসরণ করতে পারছে কিশোর। গাড়ি এখন স্যান ফ্রানসিসকোর দিকে না গেলেই বাচি-মনে মনে বলল সে।
৮
কয়েক মিনিট পুরোদমে প্যাডাল ঘোরানোর পর স্বস্তির নিঃশাস ফেলল কিশোর। সবুজ ভ্যানটা স্যান ফ্রানসিসকোর দিকে যাচ্ছে না, এমনকি সান্তা মনিকার দিকেও নয়। সোজা শহরের দিকে।
সিগন্যালের শব্দ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে কোনদিকে কখন মোড় নিচ্ছে গাড়িটা। রকি বীচের মেইন টীট দিয়ে চলেছে এখন। ইশারায় গতি কমানোর নির্দেশ দিল দুই সহকারীকে কিশোর। সিগন্যাল, অনেক জোরাল, তারমানে খুব কাছেই রয়েছে গাড়ি। ট্রাফিক পোস্টে লাল আলো দেখে থেমেছে বোধহয়। তাড়াতাড়ি চলে ওটার একেবারে গায়ের ওপর গিয়ে পড়তে চায় না সে। রিয়ার ভিউ মিররে তাদের দেখে ফেলতে পারে হ্যারিকিরি বা তার সঙ্গী।
রিচার্ড হ্যারিসের অলঙ্কারের দোকান আর ট্রাসটি ব্যাঙ্ক পেরো ওরা। হঠাৎ থেমে গেল বীপ-বীপ। হাত তুলে মুসা আর রবিনকে থামার নির্দেশ দিল কিশের। এক পা মাটিতে নামিয়ে দিয়ে সাইকেলেই বসে রইল। এদিক ওদিক ঘোরল ট্র্যাকারের অ্যান্টেনা। বায়ে ঘোরাল, শব্দ নেই। পুরো ডানে ঘোরাতেই আবার শোনা গেল বীপ-বীপ।
সামনে পথটাকে আড়াআড়ি কেটেছে আরেকটা পথ, শহরের বাইরে বেরিয়ে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। সে-পথেই এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা।
রাস্তায় মোড় আর ঘোরপ্যাঁচ এত বেশি এখন, সিগন্যাল শুনে ভ্যানটাকে অনসকণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এই আছে জোরাল বীপ-বীপ, পরক্ষণেই কমতে কমতে একবারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সিগন্যাল ধরার জন্যে বার বার অ্যান্টেনা ঘোরাতে হচ্ছে, তবে বিশেষ ভাবছে না কিশোর। আন্দাজ করে ফেলেছে, কোথায় যাচ্ছে ভ্যান।