সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি পারকিংলট থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। সে রাতে ভাল ঘুম হলো না কিশোরের। মনে ভাবনার বোঝা। টমকে হারিয়েছে ওরা, চূড়ান্ত কিছু একটা করা সম্ভব হয়নি রংকির সঙ্গে, তাকে প্রশ্ন করা যায়নি। মিস, কারমাইকেলকে বলার কিছু নেই। তাঁকে গিয়ে বলা যাবে না; তাঁর বন্ধু রিচার্ড হ্যারিস পাখিগুলোকে খুন করেছে। প্রমাণ করতে পারবে না সেটা। যদি মিস কারমাইকেল জিজ্ঞেস করেন, সাধারণ দুটো পাখিকে খুন করে রিচার্ডের কি লাভ, জবাব দিতে পারবে না কিশোর। জবাব তার নিজেরই জানা নেই। আর সত্যি কি রিচার্ডই খুন করেছে পাখিগুলোকে?
এবারের কেসটায় বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না তিন গোয়েন্দা। সূত্র একটা যা-ও ছিল হাতে, তা-ও খুইয়ে এসেছে। এখন একমাত্র ভরসা রিংকি, যদি সকালে ফোন করে কৈফিয়ত চায়। অর্থাৎ যদি সে যোগাযোগ করে। তাহলে তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করা যেতে পারে, যদিও ফোন করার সুবনাটা খুবই ক্ষীণ।
পারকিংলটে অপেক্ষা করাই বোধহয় উচিত ছিল, চলে এসে ভুল করলাম না তো? মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে ঘুম ভাঙল কিশোরের। যতগুলো প্রশ্ন মনে নিয়ে ঘুমিয়েছিল, একটারও জবাব মেলেনি।
ইদানীং তার হয়েছে আরেক বিপদ, মেরিচাচীর হঠাৎ করেই খেয়াল হয়েছে, আজকাল খাওয়ার প্রতি কিশোরের বিশেষ আগ্রহ নেই। ফলে সকালে উঠেই গাদা গাদা গিলতে হয়। মেরিচাচী সামনে বসে থাকেন, ফাঁকি দেয়ার উপায় মেই। কিশোরের ধারণা, এতে তার চিন্তাশক্তি ব্যাহত হচ্ছে।
ঘুম থেকে উঠেই দেখল কিশোর, নাস্তা রেডি। টেবিলে বসে কাগজ পড়ছেন চাচী, কিশোরকে দেখেই কাগজটা সরিয়ে রেখে প্লেট.চামচ টানাটানি শুরু করলেন।
ডিম, মাংস, মাখন, পনির, রুটি, আপেল আর দুই গ্লাস দুধ খাঙ্খার পর মনে। হলো কিশোরের, আগামী এক বছর আর কিছু খাওয়ার দরকার হবে না। এরপরও যখন কয়েকটা আঙুল মুখে দেয়ার জন্যে চাপাচাপি শুরু করলেন চাচী, রেগে গেল কিশোর। মুখের ওপর বলে দিল, যদি এরকম করে, হলে সোজা গিয়ে শুয়ে পড়বে বিছানায়, বাকাচোরা পাইপের ব্যাপারে কোন সহযোগিতা করবে না। এত ভারি পেট নিয়ে না নড়তে পারে মানুষ, না কাজ করতে পারে?
ঠিক আছে ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি হাত তুলে বললেন চাচী, এখন থাক। ঘণ্টাখানেক পরেই খাস।
গটমট করে বাইরে বেরিয়ে এল কিশোর। সোজা রওনা হলো ওয়ার্কশপে। ঢুকেই থমকে গেল। একটা বাক্সের ওপর বেশ আরাম করে বসে আছে পাখিটা। তাকে দেখেই চোখ ফিরিয়ে তাকাল।
কাছে গিয়ে পাখিটাকে তুলে নিল কিশোর। ডানা আর লেজের চকচকে পালকগুলো দেখল। না, কোন ভুল নেই। সাদা ফুটকিগুলো অবিকল এক। তাছাড়া পাখিটাও চিনতে পেরেছে তাকে, নইলে ধরা দিত না।
টম। ফিরে এসেছে।
৭
টমই, মুসা বলল, কোন সন্দেহ নেই। এই যে লেজের সাদা ফুটকি, কয়েক বছর পর দেখলেও ঠিক চিনতে পারতাম। আমাদেরকেও চিনতে পেরেছে। পারিনি, টম?
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। আবার আগের জাগায়, বড়চায় ফিরে গেছে মৈ। দানা ঠুকরে খাচ্ছে, মাঝে মাঝে চোখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে এদিকে।
রিচার্ড হ্যারিস ছিনিয়ে নিল ওকে আমার কাছ থেকে নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে চিমটি কাটছে কিশোর, কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল না কথাগুলো। কয়েক ঘন্টা পর ছেড়ে দিল কবুতরটাকে ফিরে এল ওটা আবার আমাদের কাছে। কেন?
আমাদের কাছে ফিরে আসবে হয়তো ভাবেনি হ্যারিস, বলল রবিন।
মানে? ভুরু কোঁচকাল মুসা।
বইতে পড়লাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মেসেজ বহন করত রেসিং হোমার। মিলিটারি যখন অ্যাডভান্স করত, কবুতরগুলোকে খাঁচাশুদ্ধ করে নিত, নতুন জায়গায় আটকে রাখত কয়েকদিন, তারপর ছাড়ত। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়লে আগের জায়গায় ফিরে যেত পাখিগুলো। এই কবুতরের স্বভাব হলো, পুরানো আশ্রয়ের কথা তাড়: তড়ি ভুলে যায়, দুতিন দিন অন্য কোথাও থাকলে সেটার কথাই মনে রাখে। সেখান থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় নিয়ে দু-তিন দিন রাখলে, এর আগেরটার কথা আবার ভুলে যায়। হয় তোলে, কিংবা যেতে চায় না, যেটাই হোক…
হুঁ, এজন্যেই তাহলে ফিরে এসেছে টম, মাথা দোলাল কিশোর। বলে ভালই করেছ, রবিন। পাখিটার মালিক বোধহয় রিচার্ড হ্যারিস নয়। আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তার ধারণা ছিল, বাড়ি ফিরে যাবে টম। তা না গিয়ে চলে এসেছে এখানে, স্বভাবের কারণে।
এটাই এখন তোর বাড়ি, না টম? খাঁচার ফাক দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে-পায়রাটার, মাথায় ছোঁয়াল মুসা, আদর করল। তাই ফিরে এসেছিস। খুব খুশি হয়েছি।
কথায় বাধা পড়ল। লাউডস্পীকারে বেজে উঠল মেরিচাচীর কণ্ঠ। কিশোর। কিশোর।
কিশোরের এটা আরেকটা নতুন সংযোজন। ওরা হেডকোয়ার্টারে থাকলে দরকার পড়লে ডাকেন চাচী। অনেক কারণে সব সময় সে ডাক স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে শোনা যায় না। তাই ওয়ার্কশপে একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে দিয়েছে সে হেডকোয়ার্টারে স্পীকারের সঙ্গে যোগ করে দিয়েছে।
এই কিশোর, শুনছিস? আবার ডাক শোনা গেল। ডাকের ধরন বিশেষ সুবিধের মনে হলো না মুসার কাছে। বলেই ফেলল, আল্লাহরে। কি জানি নিয়ে এসেছে রাদেশ-চাচা! এবার হয়তো বেঁকাবঁকা ইলেকট্রিকের খাম্বা, দেড় টন করে ওজন একেকটার… বলতে বলতে দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনার দিকে এগোল সে।