আরও কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর বাড়ি রওনা হলো মুসা আর রবিন। সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, মা-বাবা নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করছেন, রাতে আবার বেরোনোর আগে তাদের সঙ্গে অন্তত একবার দেখা করে আসা দরকার। ইয়ার্ডে আর ফিরবে না। ট্রাসটি ব্যাংকে পারকিংলটে চলে যাবে যার যার মত, নটার মিনিট দশেক আগে মিলিত হবে ওখানে।
সাড়ে আটটায় টমকে ছোট খাঁচায় ভরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে খাঁচাটা বেঁধে নিল কিশোর। শহরের দিকে রওনা হলো।
ব্যাংকটা মেইন স্ট্রীটে, হ্যারিসের দোকান থেকে দূরে নয়। বিশাল সাদা বাড়িটার পেছনে পার্কিংলটে সাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ল কিশোর। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে, অল্প কয়েকটা গাড়ি আছে এখন টে। পারকিঙের জায়গাটাকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে বিল্ডিং। আধো অন্ধকার সেখানে।
দেয়াল ঘেঁষে সাইকেলটা রেখে আলো নিভিয়ে দিল কিশোর, ক্যারিয়ার থেকে খুলে নিল খাঁচা।
চারপাশে তাকাল। অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছয়-সাতটা গাড়ি। কোনটাতেই প্রাণের সাড়া নেই।
ঘড়ি দেখল কিশোর। পৌনে নটা। আর পনেরো মিনিট পরে প্রংকির আসার কথা। মুসা আর রবিন আসতে আর পাঁচ মিনিট। পার্কিংলটের প্রবেশ মুখে ওদের অপেক্ষায় থাকার সিদ্ধান্ত নিল সে। ওখানে আলো আছে যথেষ্ট, রর লাইটের আলো। পা বাড়াল।
এই ছেলে, থামো, পেছনের অন্ধকার ছায়া থেকে বলে উঠকেউ।
যা বলা হলো করল কিশোর। যেখানে ছিল সেখানেই অনড় হয়ে গেল, খাচটা দুহাতে পেটের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরেছে।
আস্তে করে ঘোরো, আবার আদেশ হলো।
যতখানি আস্তে পারল ঘুরল কিশোর।
বিষণ্ণ ছায়া থেকে বেরিয়ে এল লোকটা। সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে ডাক হাত। কিছু একটা ধরে রেখেছে। আধো অন্ধকারেও চমকাচ্ছে জিনিসটা।
আগ্নেয়াস্ত্রের ধাতব নল, চিনতে কোন অসুবিধে হলো না কিশোরের। চেঞ্জ সরাতে পারল না ওটার ওপর থেকে।
খাঁচাটা রাখো তোমার সামনে, মাটিতে, আদেশ দিল লেকট। ঝুঁকে রাখল কিশোর।
আরেকটু কাছে এল লোকটা। কিশোরের দিক থেকে নল না সরিয়েই উবু হলো, পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলো কবুতরটা রয়েছে খাঁচার ভেতরে।
গুড।
সোজা হলো লোকটা। চকিতের জন্যে তার চেহাব স্পষ্ট দেখতে পেল কিশোর। উজ্জল কালো অয়েলস্কিন পরনে, চোখে কালো চশম, মুখ ঢেকে আছে দাড়িগোফ। রিচার্ড হ্যারিস।
ঘোরে, বলল লোকটা। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো মাটিতে।
লোকটার কণ্ঠস্বর অবাক করল কিশোরকে। নিচু পর্দ, কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে, যেন জোর করে বলছে। আমার চেয়ে কম ভয় পাচ্ছে না ব্যাটা-ভাবল কিশোর, এবং সেটা লুকাতে চাইছে।
শাসানোর ভঙ্গিতে নল নড়ল লোকটা।
আর দ্বিধা করল না কিশোর, যা বলা হলো, করল। শুয়ে পড়ল।
দুই হাত পেছনে, পিঠের ওপর তুলে আনো।
তুলল কিশোর। কানে এল হেঁড়ার শব্দ, টেনে কাপড় ঘেঁড় হচ্ছে নাকি, রোল থেকে অ্যাঢেসিভ টেপ হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছাড়াচ্ছে? মুহূর্ত পরেই বুঝল, কি জিনিস। টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হলো তার হাত, দড়ি কিংবা কাপড়ের ফালির চেয়ে অনেক শক্ত বাঁধন।
নড়ল না কিশোর। চমকে নলের চেহারাটা মনের পর্দায় উজ্জ্বল। চুপচাপ শুয়ে অনুভব করল, পা-ও বাধা হচ্ছে।
শুনল, চলে যাচ্ছে লোকটার পদশব্দ। পেছনে কোথাও গুঞ্জন তুলল গাড়ির এঞ্জিন, হেড লাইট জ্বলল। হাত-পা এমনভাবে বাঁধা, মাথা তুলতেও অসুবিধে হচ্ছে। তবু যতখানি পারল তুলল, সাবধানে, ঘুরে তাকাল।
চলতে শুরু করেছে গাড়ি। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না গাড়ির বডি, চেনা না অচেনা বোঝা যাচ্ছে না। বিশগজ দূর দিয়ে চলে গেল গাড়ি, টায়ারের কর্কশ শব্দ তুলে মোড় নিয়ে নামল রাস্তায়, অদৃশ্য হয়ে গেল।
শুয়ে শুয়ে নিজেকে দোষারোপ করছে কিশোর। পারকিংলটে ঢোকার আগে মুসা আর রবিনের জন্যে অপেক্ষা করা উচিত ছিল। অন্ধকারে বোকর মত ঢুকে পড়েছে একা একা, লোকটাকে সুযোগ দিয়েছে।
গেটের দিক থেকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। সাইকেলের লাইট দেখা গেল।
মুসা, ডাকল কিশোর। রবিন।
দুপাশ থেকে কিশোরের ওপর ঝুঁকে বসল দুই সহকারী গোয়েন্দা। কজি আর গোড়ালি থেকে টেপ তুলতে শুরু করল। চড়চড় করে রোম ছিড়ে নিয়ে উঠে আসছে টেপ, জ্বালা করছে, চামড়ায়।
আহত জায়গা ডলতে ডলতে জানাল কিশোর কি ঘটেছে।
নরম শিস দিয়ে উঠল মুসা, পিস্তল
তাই তো মনে হলো, উঠে দাঁড়াল কিশোর। গুলি ভরা ছিল কিনা জিজ্ঞেস করিনি, যদি আমার ওপরই প্রমাণ করে দেখাতে চায়। প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ঝলল, তোমরা কিছু দেখেছ?।
মাথা ঝেকাল রবিন। গাড়ি দেখলাম একটা, কালো। ক্লিংকিরটার মতই মনে হলো। লাইসেন্স প্লেটে দেখলাম এম ওকে লেখা। ঠিক
রিংকির গাড়ির প্লেটে যে রকম লেখা ছিল বলল কিশোর। যেটাতে করে স্ন্যাকস রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। যেটা… নিশ্চিত নয়, তাই বাক্যটা শেষ করল না সে। রিচার্ড হ্যারিসের অলঙ্কারের দোকান থেকে বেরিয়ে সেদিন যে গাড়িটা দেখেছে, সেটার কথাই বলতে যাচ্ছিল। লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার পুরোটা পড়তে পারেনি, তবে শুরুতে এম লেখাটা দেখেছে বলে মনে পড়ছে।
তো, এখন কি করা? মুসা বলল। টমকে নিয়ে গেছে হ্যারিস, রিংকি…
হ্যাঁ, মুসার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল রবিন, রিংকি এলে তাকে কি জবাব দেব?
ঘড়ি দেখল কিশোর। নটা বাজতে দুই মিনিট বাকি। কিছুই না, কারণ তার জন্যে.আর অপেক্ষাই করছি না আমরা। চলো কেটে পড়ি। যার যার বাড়ি চলে যাব। সকালে হেডকোয়ার্টারে আলোচনা হবে।