সঙ্কেতের জবাব দিল মুসা। ছুটে আসতে শুরু করল।
কিশোর?
এই যে, এখানে আমি।
ঝোপের ওপাশ থেকে ঘুরে এসে দাঁড়াল মুসা। একটু পরেই উল্টো দিক থেকে এসে পৌছুল রবিন।
কাঁধ ডলেই চলেছে কিশোর। ব্যথা একটু কমছে মনে হচ্ছে।
কি হয়েছে, কিশোর উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল রবিন।
রিচার্ড হ্যারিস, বলল কিশোর। ব্যাটা আমাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছে। কপাল ভাল মাথায় লাগেনি, তাহলে গেছিলাম।-মুখে আলো পড়তেই চমকে গেল, ছুটে পালাল। ওই যে ওদিকে, হাত তুলে দেখাল। কোন শব্দ শোনোনি? দেখেছ ওকে?
নাহ্। ঝোপঝাড় খুব বেশি। আর গেটের দিকে গিয়ে থাকলে আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার কথা না।
পিছু নেব নাকি? বলল বটে মুস্য, কিন্তু অন্ধকারে একটা বাজে লোককে অনুসরণের কথা ভাবতেই জানি কেমন লাগছে, তাছাড়া লোকটার হাতে রয়েছে। মোটা লাঠি, অন্যের মাথায় বাড়ি মারার প্রবণতাও আছে।
না, মুসার মত একই কথা ভাবছে কিশোরও। একটা কিছু আছে এখানে, ওব্যাটার জন্যে দেখতে পারিনি ভালমত। আলো ফোল ঝোপের কিনারে। কালোমত বস্তুটার কাছে এসে বলল আবার, তার পাশে বসল রবিন আর মুসা।
খাইছে! মুসা চেঁচিয়ে উঠল এ-যে দেখছি, এ-যে দেখছি…
হ্যাঁ, কাল কিশোর, ঠিকই দেখছ। মরা কবুতর।
কবুতর না বলে বলা উচিত কবুতরের অবশিষ্ট। মাথাসহ শরীরের ওপরের অংশ নেই, টেনে ছিড়ে ফেলা হয়েছে, বাকি রয়েছে লেজের কাছের অতি সামান্য চামড়া আর মাংস, পালকগুলো গেঁথে রয়েছে তাতে। একটা ডানার খানিকটা আর পা দুটোও আছে।
হাত বাড়িয়ে একটা পা তুলে নিল কিশোর। গোড়ালিতে অ্যালুমিনিয়মের পাতলা আংটা পরানো। নিজের লাইট মাটিতে রেখে রবিনের লাইটের আলোয় পা থেকে জিনিসটা খুলল সে, পাতলা মোড়কের ভেতর ছোট একটা উজ করা কাগজ। সাবধানে মোড়কের জোড়া দুটিয়ে সোজা করল, ভেতরের কাগজ বের করে মেলল। সমান করল হাত দিয়ে ডলে।
বুকের মত গলা বাড়িয়ে দুপাশ থেকে কাগজটার ওপর ঝুঁকে এল অন্য দুজন।
হায় হায়, এটা কি ভাষা? বলে উঠল মুসা। চীনা নাকি?
ছাপার অক্ষর হলে হয়তো বোঝা যেত, কিন্তু হাতে লেখা, তাই প্রথমে রবিনও চিনতে পারল না। চীনাই বোধহয়, বিড়বিড় করল সে। না না, জাপানী পাঠকও আছে, বই নিতে আসে। চিনি কয়েকজনকে।
চিন্তিত জিতে মাথা নাড়ল কিশোর, কাগজটা বহ করে রেখে দিল পকেটে। তারপর বুকে আবারদেখতে লাগল কবুতরের দেহাবশেষগুলো।
দেখো দেখো, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে, বা পা-টা দেখো!
মুসা আর রবিনও দেখল।
যে-ই মেরেছে পাখিটাকে, কোন কারণে পা-দুটো নষ্ট করেনি, নিচের অংশ অক্ষত রয়েছে। বাঁ পায়ে তিনটের জায়গায় রয়েছে দুটো আঙুল।
৬
আজ মুক্তো নেই, সাইকেল চালাতে চালাতে আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। তার পাশে পাশে চলেছে রবিন আর মুসা।
সকাল বেলায়ই বেরিয়ে পড়েছিল ওরা। রবিনের পরিচিত একজন জাপানী, ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়েছিল। লাইব্রেরিতে বই নিতে আসেন তিনি প্রায়ই। তাকে দিয়ে মেসেজটা পড়িয়েছে, মর্মোদ্ধার করেছে। তিনটে শব্দ শুধু লেখা : আজ মুক্তো নেই।
ভাবনার ঝড় বইছে গোয়েন্দাপ্রধানের মাথায়। মুক্তো। কবুতর। মৃত দোয়েল। মৃত বাজ পাখি। আর রিচার্ড হ্যারিস।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছে দেখা গেল, উত্তেজিত হয়ে আছেন মেরিচাচী। ভারি ভারি অনেক মালপত্র নিয়ে এসেছেন, রাশেদ চাচা। সেগুলো গোছাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ইয়ার্ডের দুই বিশালদেহী কর্মচারী, দুই ব্যাভারিয়ান ভাই, বোরিস ও রোভার।
তিন কিশোরকে দেখে এগিয়ে এলেন মেরিচাচী। এই যে, তোরা এসেছিস। ভালই হয়েছে। তোর চাচার কাণ্ড দেখ কিশোর, কি সব নিয়ে এসেছে। বাকাচোরা এসব লোহার পাইপ দিয়ে হবেটা কি? বিক্রি হবে ওজন দরে ছাড়া? আর তাতে লাভ তো কিছু হবেই না, লোকসান যাবে প্রচুর।
ভেব না চাচী, লোকসান যাবে না, আশ্বাস দিল কিশোর। কোন একটা উপায় হয়ে যাবেই।
অফিসের বাইরে ছায়ায় বসে পাইপ টানছিলেন রাশেদ পাশা, মুখ থেকে সরিয়ে খুকখুক করে কাশলেন, মস্ত গোঁফের ডগার আলতো মোচড় দিয়ে উঠে এলেন। বোঝা তুই, কিশোর, আমি তো পারলাম না। তখন থেকে চেঁচামেচি করছে।
কি করে বিক্রি হবে শুনি? কোমরে দু-হাত রেখে দাঁড়ালেন মেরিচাচী।
হবে হবে, আবার পাইপ মুখে দিলেন রাশেদ পাশা, কিশোরের দিকে তাকালেন, ইচ্ছে, বুদ্ধিটা বাতলে দিক কিশোর।
হবে হবে তো বলছই শুধু, কি করে হবে?
এই কিশোর, বলে দে না, ভাতিজার ওপর গভীর আস্থা রাশেদ চাচার, হার স্থির বিশ্বাস আইনস্টাইন কিংবা নিউটনের চেয়ে কোন অংশে কম যায় না কিশোর, একটা উপায় বের করে ফেলবেই।
চাচী, তুমি খামোকা ভাবছ। বাজারে পাইপের যা দাম এখন, বলল কিশোর, ডবল দামে বিক্রি করতে পারব। গত বছর পাইপ ঢালাইয়ের একটা বাতিল মেশিন এনেছিল না চাচা, যেটা পড়ে আছে এখনও, সেটা মেরামত করে নেব। তারপর মুক্তোশিকার জনা দুই ঢালাই মিস্ত্রিকে ভাড়া করে নিয়ে এলেই হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। মেশিনটাও বিক্রি হবে, পাইপগুলোও ডবল দর…
হো হো হো, মুখ থেকে পাইপ খসে পড়ল রাশেদ পাশার তোলার চেষ্টা করলেন না, হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন বাচ্চা ছেলের মত। মেরি বেগম, এবার কি বলবে? আঞ্চলিক বাংলায় টেনে টেনে বললেন, কইছিলাম না, আমাগো কিশোর থাকতে কোন চিন্তা নাই। অই মিয়ারা, খাড়া খাড়ায়া কি দেখছো, তোলো তোলো, তুইল্লা রাখো পাইপলান। শেষ কথাগুলো দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, কিন্তু কিছুই বুঝল না ওরা, হাঁ করে চেয়ে আছে রাশেদ পাশার মুখের দিকে।