সৈকত ধরে এগোল ওরা আবার। অনেকখানি শান্ত হয়ে এসেছে। রাফিয়ান, পিছে পিছে চলেছে, সুযোগ পেলেই চেটে দিচ্ছে জর্জের হাত।
এক জায়গায় কয়েকটা বড় বড় পাথর নেমে গেছে পানিতে, ওখানে নৌকা বাধা। একে একে উঠে পড়ল অভিযাত্রীরা, নৌকা ঠেলে পানিতে নামিয়ে দিল-ফগ। দাঁড় তুলে নিল জর্জ।
তীরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাল ফগ। চেঁচিয়ে বলল, বেশি দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি চলে যান। ঝড় আসবে।
জানি, চেঁচিয়ে জবাব দিল জর্জ। ভেবো না, ঝড়ের আগেই দ্বীপে উঠে যাব। আসতে দেরি আছে এখনও।
দাঁড় বেয়ে চলল জর্জ। রাফিয়ানের আনন্দের সীমা নেই। ছোট্ট নৌকাটা ঢেউয়ের তালে তালে নাচছে, সেই সঙ্গে নাচছে কুকুরটা। লাফ দিয়ে একবার নৌকার এ-মাথায় চলে আসছে, আরেকবার ও-মাথায়। দুলে উঠছে নৌকা। তাতে আরও মজা পাচ্ছে সে, গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।
এক দৃষ্টিতে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দা, কাছিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দ্বীপটার দিকে চেয়ে চেয়ে আগের দিনের মতই উত্তেজনা বোধ করছে।
জর্জ, এক সময় বলল কিশোর, উঠব কোন দিক দিয়ে? খালি তো দেখছি পাথর আর পাথর, নৌকা ভেড়ানোর জায়গা কোথায়?
আছে, আছে, রহস্যময় হাসি হাসল জর্জ। কাল বলেছিলাম না, ছোট্ট একটা জেটি আছে? লুকানো। দ্বীপের পুব ধারে।
দক্ষ হাতে চোখা পাথরের ফাঁক দিয়ে ডিঙিটাকে চালিয়ে নিয়ে চলল। জর্জ, পাকা মাঝি সে কোন সন্দেহ নেই। সামনে চোখা পাথরের দেয়াল, তার পরে কী আছে দেখা যায় না। একটা ফাঁক দিয়ে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। জর্জ, দেয়ালের অন্য পাশে চলে এল। জেটিটা দেখতে পেল সবাই। প্রাকৃতিক জেটি। সাদা বালিতে ঢাকা ছোট্ট একটুকরো সমতল জায়গা, প্রায় চারপাশ থেকেই ঘিরে রেখেছে উঁচু পাথরের দেয়াল। বাইরে থেকে জায়গাটা দেখা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
সরু প্রণালী ধরে এগিয়ে চলেছে ডিঙি, জেটির দিকে। শান্ত পানি কাঁচের মত পরিষ্কার। রঙিন ছোট ছোট মাছগুলোকে মনে হচ্ছে রঙিন স্ফটিকে তৈরি। মুগ্ধ হয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দা।
ইস, কী সুন্দর! জ্বলজ্বল করছে কিশোরের চোখ। তুমি। ভাগ্যবতী।
ঝট করে চোখ তুলে তাকাল জর্জ। মুসা ঠিক খেয়াল করল না ব্যাপারটা, কিন্তু রবিন অবাক হলো। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ঘঁাচ করে বালিতে ঠেকল নৌকার তলা, ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ডিঙি।
হলদে সাদা মসৃণ বালিতে লাফিয়ে নামল ওরা।
সত্যিই তা হলে দ্বীপে পৌঁছলাম! খুশিতে ওখানেই এক গড়ান দিল রবিন। তার সঙ্গে যোগ দিল রাফিয়ান। হেসে উঠল অন্যেরা।
টেনে নৌকাটাকে ডাঙায় তুলতে শুরু করল জর্জ। তার সঙ্গে হাত মেলাল মুসা। আর বেশি ওপরে তুলে কী হবে? জোয়ার কি এত ওপরে আসে? ১ঝড় আসবে ভুলে গেছ? পানি এখন শান্ত, ঝড়ের সময় দেখবে কী রকম ফুঁসে ওঠে। নৌকাটাকে টেনে নামিয়ে বাড়ি মেরে গুড়ো করে দিক, তাই চাও?
না, চায় না মুসা, পারলে এখন পাহাড়ের মাথায় তুলে রাখে। নৌকাটাকে।
চলো, চলো, ঘুরেফিরে দেখি, তর সইছে না রবিনের। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছে সে। এসো, এসো।
ছোট্ট একটা পাহাড়, আসলে টিলা বলাই উচিত। ওটা পেরিয়ে মোটামুটি একটা সমতল জায়গায় চলে এল ওরা। এত সুন্দর জায়গা খুব কমই দেখেছে তিন গোয়েন্দা। আশপাশে খরগোশের ছড়াছড়ি। ওর কাছাকাছি এলেই একটু সরে যাচ্ছে, ভয় পেয়ে গর্তে ঢোকার কোন লক্ষণই নেই জানোয়ারগুলোর মাঝে।
এক্কেবারে পোষা! অবাক হয়ে বলল কিশোর।
এখানে কেউ আসে না তো, তাই। আমিও ভয় দেখাই না ওদের। কুকুরটার দিকে চেয়ে হঠাৎ ধমকে উঠল জর্জ, এই, রাফি, রাফি, এলি এদিকে! ধরে থাপ্পড় লাগাব কিন্তু।
একটা খরগোশকে তাড়া করেছিল রাফিয়ান, মাঝপথেই যেন হোঁচট খেয়ে থেমে গেল, ফিরে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল জর্জের দিকে। এই একটা ব্যাপার বুঝতে পারে না সে, আর কোন কিছুতেই মানা করে না, শুধু খরগোশ তাড়া করলে এত রেগে যায় কেন তার মনিব? বিষণ্ণ ভঙ্গিতে ফিরে এল রাফিয়ান, ছেলেদের পাশে পাশে সুবোধ বালকের মত হেঁটে চলল, খরগোশগুলোর দিকে নজর, রসগোল্লার থালার দিকে যে চোখে তাকায় পেটুক ছেলে, চোখে সেই দৃষ্টি।
মনে হচ্ছে হাত থেকেই খাবার নিয়ে খাবে? খরগোশ দেখিয়ে বলল। কিশোর।
মাথা নাড়ল জর্জ। না, চেষ্টা করেছি, আসে না। ওটুকু ভয় রয়েই গেছে। …আরে, ওই বাচ্চাটা দেখেছ! কী সুন্দর, না?
হুফ! স্বীকার করল রাফিয়ান, মনিবের আঙুল তোলা দেখে ভাবল ছাড়পত্র পেয়ে গেছে, কিন্তু লাফ দিয়ে বাচ্চাটার দিকে এগোতে গিয়েই থেমে গেল। আবার ধমকে উঠেছে মনিব, এই, শয়তান, কান ছিঁড়ে দেব কিন্তু!
দুপায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে আবার ফিরে এল রাফিয়ান।
এসে গেছি! হঠাৎ বলে উঠল কিশোর।
হ্যাঁ, ওই যে সিংহ-দরজা, হাত তুলে দেখাল জর্জ। ওখান দিয়েই দুর্গে ঢুকতে হবে।
বিশাল দরজা ছিল এক কালে, মস্ত বড় দুই থাম, ওপরে ধনুকের মত বাঁকানো খিলানের অর্ধেকটা বিশিষ্ট রয়েছে এখন, ঝুলে আছে বেকায়দা ভঙ্গিতে, ওটাও খসে পড়তে পারে যে-কোন সময়। ওপাশ থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাথরের ভাঙা সিঁড়ি, দুর্গের ঠিক গোড়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
দুর্গ ঘিরে উঁচু দেয়াল ছিল এক সময়, বলল জর্জ। এখন জায়গায় জায়গায় পড়ে গেছে। টাওয়ার ছিল দুটো, দেখতেই পাচ্ছ, একটা পড়ে গেছে।