একটু কাত হয়ে রয়েছে না? দেখতে দেখতে বলল কিশোর। জর্জ, নামা যায় না?
কেন যাবে না? জর্জ হাসল। নামতে চাইলে নামো। ভয় লাগবে না তো?
আরে, দূর, কী যে বলো! আগেও নেমেছি, পুরানো জাহাজের খোল পানির তলায় নেমে দেখার অভ্যাস আছে। তবে ডুবুরির পোশাক পরে। ওসব ছাড়া নামতে পারব?
পারবে, যদি দম বেশিক্ষণ রাখতে পারো।
আমি পারব, জ্যাকেট খুলতে শুরু করেছে মুসা। সাঁতারে ওস্তাদ
শুধু জাঙ্গিয়া পরে আস্তে করে নেমে পড়ল মুসা। ডিগবাজি খেয়ে ঘুরিয়ে ফেলল শরীরটাকে পানির তলায়, মাথা নিচু করে দ্রুত নেমে চলল হাত-পা চালিয়ে।
তুমি যাবে? রবিনের দিকে তাকাল কিশোর।
মাথা নাড়ল রবিন। তোমরাই যাও, আমার সর্দি সর্দি ভাব।
কঙ্কাল দ্বীপে সর্দি হয়েছিল আমার, এখানে হলো তোমার, হাহ্! কাপড় খোলা হয়ে গেছে, নেমে পড়ল কিশোর।
মাথা নিচু করে সাঁতরে নিচে নামার সময় কীভাবে চোখ খোলা রাখতে হয়, জানা আছে কিশোরের, ডাইভিঙে দক্ষ ওস্তাদের কাছে ট্রেনিং নিয়েছে। চলার পথে আশপাশে তাকিয়ে দেখছে সে। বড় বেশি নীরব আর কেমন যেন বিষণ্ণ লাগছে এখানে। ওপর থেকে পানি নীল মনে হয়, কিন্তু এখানে কালচে, আশপাশে কালো কালো ছায়া-বিকেল বলেই, গা
ছমছম করে। নিচে জাহাজের অবয়ব আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাত হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে এক অজানা ভয়ঙ্কর দানব, সাড়া পেলেই জেগে উঠবে।
মুসার মত এতক্ষণ দম রাখতে পারল না কিশোর, আবার ওপরে ভেসে উঠতে পেরে খুশিই হলো। হাউস করে জোরে শ্বাস ফেলে নৌকায় উঠে এল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দারুণ! …ভেতরে ঢুকে ভালমত খুঁজে দেখতে পারলে ভাল হত। কে জানে, সোনার বাক্সগুলো…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই নৌকার পাশে ভেসে উঠল মুসা। সেদিকে চেয়ে জর্জ বলল, নেই। এক তিল জায়গা খোঁজা বাকি রাখেনি ডাইভাররা। কিছু পায়নি। পশ্চিম দিগন্তে তাকাল সে, বেলা আন্দাজ করল। আর দেরি করা যাবে না। চলো, নইলে চায়ের দেরি হয়ে যাবে।
তাড়াহুড়ো করেও দেরি হয়েই গেল, বেশি না, মিনিট দশেক। চা নিয়ে অপেক্ষা করছেন মিসেস গোবেল।
চা খেয়ে আবার একটু হাটাহাটি করতে বেরোল ছেলেরা, জলার ধারে চলে এল। তাদের পায়ের কাছে নাচানাচি করছে রাফিয়ান, উল্লাসে।
সন্ধ্যা নামছে। বাড়ি ফিরছে জলার সব পাখিরা। এখানে-ওখানে শুধু দুএকটা সাদা বক ধ্যানমগ্ন হয়ে এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে রয়েছে, শেষ লোকমা খাবারের আশায়।
বাড়ি ফিরল ছেলেরা। রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেল।
গুড নাইট, জর্জ, ঘুমজড়ানো গলায় বলল রবিন। চমৎকার একটা দিন কাটল, তোমারই জন্যে, ধন্যবাদ।
কাল আরও সুন্দর কাটবে, জর্জের কণ্ঠেও ঘুম। কাল আমার দ্বীপে নামব তোমাদের নিয়ে, দুর্গ দেখাব…দুর্গ…
জর্জের শেষ কথাটা রবিনের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না, ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
পাঁচ
সবার আগে রবিনের ঘুম ভাঙল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, উজ্জ্বল রোদ, চমৎকার আবহাওয়া। জর্জকে ডেকে তুলল সে। হাই তুলতে তুলতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল জর্জ। উমম! আজ না গেলেই ভাল!
কেন! কেন! আঁতকে উঠল রবিন।
ঝড় আসবে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে জর্জ, চিন্তিত।
কিন্তু আবহাওয়া তো পরিষ্কার! জর্জের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। সূর্যের সামনে ছায়া নেই, এক রত্তি মেঘ নেই আকাশে।
বাতাসের গতি উল্টোপাল্টা, টের পাচ্ছ না? আর ওই দেখো, দ্বীপের কাছে যে ঢেউ ভাঙছে, মাথাগুলো সাদা। অশুভ সঙ্কেত।
যাবে না তা হলে? হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। রাফিয়ানের কথা ভেবেছ? আমাদের সঙ্গ না পেলে আজ কী রকম দুঃখ পাবে ও?
হেসে ফেলল জর্জ। ঠিক আছে, ঠিক আছে, যাব, যাব। কেঁদে ফেলো না।
কী যে বলো! রবিনও হাসল, লজ্জা পেয়েছে। আচ্ছা, ঝড়টা কতখানি খারাপ… বলেই জর্জের চেহারা দেখে থেমে গেল; আবার না মানা করে বসে যেতে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি বলল, আর খারাপ হলে হলো। ঝড়ের ভয়ে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি দেখি, কিশোর আর মুসা উঠেছে কিনা।
ভরপেট নাস্তা করল চারজনে। ছেলেরা দ্বীপে যাবে শুনে পোটলা করে খাবার বেঁধে দিলেন জর্জের মা, অনেক খাবার। বলে দিলেন, গায়ের বাজার থেকে কিছু লেমোনেডের বোতল কিনে সঙ্গে নিতে। যেখানে সেখানে যেন পানি না খায়, বার বার হুশিয়ার করে দিলেন। সৈকতের পথ ধরে হেঁটে চলল ওরা। সবাই খুশি। ঝড়ের কথা কিশোর আর মুসাও শুনেছে, কিন্তু খুব একটা আমল দিচ্ছে না। ঝড়ের।
আগে দ্বীপে পৌঁছে যেতে পারলে আর কোন ভয় নেই।
ফগদের বাড়িতে পৌঁছল ওরা। বাড়ির পেছনে শেকলে বাঁধা রয়েছে রাফিয়ান, ওদেরকে দেখেই হউ-হউ করে উঠল। চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এল ফগ।
মর্নিং, মাস্টার জর্জ, বলল সে। তার কণ্ঠস্বর অবাক করল রবিনকে, কেন যেন মনে হলো, মাস্টার বলতে বাধছে ফগের। রাফিয়ানের বাধন খুলে দিল সে।
খুশিতে পাগল হয়ে গেল যেন রাফিয়ান। ছেলেদেরকে ঘিরে নাচছে, আর ঘেউ ঘেউ করছে।
গুড মর্নিং, রাফি, হেসে বলল কিশোর। আরে, অমন পাগল হয়ে গেলি কেন? আয়, এদিকে আয়।
লাফিয়ে এসে কিশোরের পায়ের কাছে পড়ল রাফিয়ান। তার গায়ে দুপা তুলে দিয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল, কান চেটে দিল, কিশোরের। পরক্ষণেই লাফিয়ে গিয়ে পড়ল জর্জের গায়ে।