ছেলেদের সাড়া পেয়েই চোখ মেলল রাফিয়ান, তড়াক করে উঠেই লম্বা লেজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে এল। ফগ ফিরে তাকাল।
এসেছেন, উঠে দাঁড়িয়েছে ফগ। আসুন, নৌকা তৈরি। …এরাই আপনার বন্ধু? হাত বাড়িয়ে দিল সে।
একে একে হাত মেলাল তিন গোয়েন্দা।
নৌকায় উঠল চার কিশোর, রাফিয়ানও উঠল। ধাক্কা দিয়ে ডিঙিটাকে পানিতে নামিয়ে দিল ফগ, আরেক ঠেলা দিয়ে ছেড়ে দিল। দাঁড় তুলে নিয়েছে জর্জ, পানিতে ফেলল ঝপাং করে।
সুন্দর বিকেল। নীল সাগর, ছোট ছোট ঢেউ। তিরতির করে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে ডিঙি, চারপাশ থেকে এটাকে ঘিরে রেখেছে। ঢেউয়ের সাদা ফেনা। এক পাশ থেকে এসে ছলাত করে বাড়ি মারছে ঢেউ, পানি ছিটকে উঠছে; মাথায় পানি পড়ার ভয়ে চট করে মাথা নুইয়ে ফেলছে রাফিয়ান, বার বার। হউউ করে ধমক লাগাচ্ছে ঢেউকে।
এই, দুই, বকা দিল জর্জ, চুপ করে বস।
আহা, করুক না একটু দুষ্টুমি, খাতির করতে চাইছে মুসা। কুকুরের বাচ্চা বটে, কিন্তু খুব ভাল মানুষ।
তা ঠিকই বলেছ, কুকুর যে কী করে মানুষ হলো, বোধহয় জর্জের মনেও জাগল না প্রশ্নটা। ঢেউকে ধমকাচ্ছে বটে, কিন্তু ভয় একটুও পায় না। ও খুব ভাল সাঁতারু।
হুফ! প্রশংসা বুঝতে পারল যেন রাফিয়ান; প্রথমে মুসার কান, তারপর জর্জের নাক চেটে দিল খুশি হয়ে।
বাহ, বুঝতে পারে তো? হাসিমুখে বলল মুসা।
তা তো পারেই, মাথা ঝোকাল জর্জ। ও সব কথা বুঝতে পারে।
এই যে, এসে গেছি, দ্বীপটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। যা ভেবেছি তার চেয়ে অনেক বড়!
আরও কাছে এসে গেল দ্বীপ। চারপাশে চোখা পাথরের। ছড়াছড়ি-দ্বীপের ধারে, পানিতে। জায়গা জানা না থাকলে কোন নৌকা কিংবা জাহাজ নোঙর করতে পারবে না, যেতেই পারবে না কাছে। দ্বীপের ঠিক মাঝখান থেকে গজিয়েছে একটা পাহাড়, তার মাথায় দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। শ্বেতপাথরে তৈরি হয়েছিল, দাঁড়িয়ে রয়েছে আধখানা ধনুকের মত ভাঙা খিলান, মোটা স্তম্ভ, কিছু কিছু দেয়াল। এক কালের শির উঁচু করে থাকা চমৎকার দুর্গে এখন দাঁড়কাকের বাসা, উঁচু থাম আর খিলানের মাথায় সার দিয়ে বসে আছে অগুনতি সী-গাল।
গা শিরশির করে দেখলে! কিশোর বলল। এত পুরানো ভাঙা দুর্গ আর দেখিনি। ভেতরে ঢুকে দেখা দরকার। রাত কাটাতে কেমন লাগবে। ওখানে!
হাত থেমে গেল জর্জের, ঝট করে চোখ ফিরিয়ে তাকাল। এক্কেবারে মনের কথাটা বলেছ! কখনও কাটিয়ে দেখিনি, একা একা সাহসই পাইনি। এবার দেখব। চারজন একসঙ্গে থাকলে আর…কি বলো? দারুণ হবে না?
হবে, রবিন বলল। কিন্তু তোমার মা কি রাজি হবে?
জানি না, মাথা নাড়ল জর্জ। তবে হয়েও যেতে পারে চেপে ধরলে।
আজ দ্বীপে নামছি তো? কিশোর জানতে চাইল।
সময় হবে না, জর্জ বলল। দ্বীপ ঘুরে গিয়ে জাহাজ দেখে আবার সাঁঝের আগে বাড়ি ফেরা, তাতেই দেরি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, চলো, আগে জাহাজটাই দেখি। দেখি, অনেক বেয়েছ, হাত বাড়াল কিশোর, এবার আমাকে দাও।
ওসব আমার অভ্যাস আছে, দাঁড় পানি থেকে তুলে ফেলল জর্জ। তবু নাও। বসে থাকতে পারলে কাজ করে কে? হাসল সে। হুশিয়ার! পাথরে লাগিয়ে দিয়ো না!
জায়গা বদল করল কিশোর আর জর্জ।
দাড় পানিতে ফেলল কিশোর। দুলে উঠল ডিঙি, নাক ঘুরে গেল শাই। করে। কিন্তু সামলে নিল সে। জর্জের মত অত ভাল বাইতে পারে না। ডিঙির নাক এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে সামান্য, তাতে অসুবিধে নেই, সোজা পথে চললেই হলো।
দ্বীপের অন্য পাশে চলে এল ওরা, খোলা সাগরের দিকে। দুর্গের এদিকটা একেবারে ভেঙে পড়েছে, স্তূপ হয়ে আছে সাদা পাথর।
খোলা তো, বাতাসের ঝাঁপটা খুব বেশি এদিকে, বুঝিয়ে বলল জর্জ। তাই ওই অবস্থা। জানো, এদিকে একটা ছোট্ট জেটি আছে, গোপন জেটি। দ্বীপের ভেতরে ঢুকে যাওয়া একটা খাড়িতে। এখন শুধু আমি জানি কোথায় আছে।
খানিক পরে কিশোরের হাত থেকে আবার দাঁড় নিয়ে নিল জর্জ, জায়গাটা খারাপ, আর কারও হাতে নৌকার দায়িত্ব দিতে সাহস পাচ্ছে না সে। দ্বীপের ধার ধরে আরও কিছু দূর চলে হঠাৎ ডিঙির নাক ঘোরাল, বেয়ে নিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে। একটা জায়গায় এসে দাঁড় বাওয়া থামিয়ে ফিরে তাকাল দ্বীপের দিকে।
জাহাজটা কোথায় কী করে বুঝবে? কিশোর ভুরু কোঁচকাল।
ওই যে, গাঁয়ের গির্জার চূড়াটা দেখছ? হাত তুলে দেখাল জর্জ। আর ওই পাহাড়ের মাথা? দুটোকে দুটো বিন্দু ধরো। এইবার দ্বীপের ওই যে বড় বড় দুটো টাওয়ার, ওগুলোর মাঝখান দিয়ে তাকাও। টাওয়ারের মাথা দুটোকে দুটো বিন্দু ধরো। চারটে বিন্দু এক লাইনে হয়েছে?
না, মাথা নাড়ল কিশোর আস্তে করে, হয়নি এখনও। টাওয়ারের মাথা দুটো একটু উঁচু মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, আস্তে আস্তে ডিঙিটাকে সরিয়ে নিয়ে চলল জর্জ।
খোলা সাগরের তুলনায় পানি এখানে বেশ শান্ত। কালচে-নীল একটা আয়না যেন বিছিয়ে রয়েছে। নৌকার ধার দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে মুসা আর ববিন, জাহাজটা দেখা যায় কিনা খুঁজছে।
আরেকটু বায়ে সরাতে হবে, জর্জ বলল।
হুফ! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রাফিয়ান। জোরে জোরে লেজ নাড়ছে।
হয়েছে! কিশোরও চেঁচিয়ে উঠল। এক লাইনে এসে গেছে চারটে বিন্দু! থামো! কিন্তু সে বলার আগেই দাঁড় বাওয়া থামিয়ে দিয়েছে জর্জ।
নৌকার কিনারা দিয়ে নিচে উঁকি দিল চার কিশোর, রাফিয়ানও গলা বাড়িয়ে দিল। প্রথমে কিছুই চোখে পড়ল না, তারপর ধীরে ধীরে আবছামত দেখা গেল একটা বিশাল কালো অবয়ব, ওটাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মোটা খুটি-ভাঙা মাস্তুল!