আরে, দূর! যতসব গল্প। কুকুর আবার কাঁদে নাকি? মুসা ফস করে ।বলে বসল।
দপ করে জ্বলে উঠল জর্জের চোখ। তুমি ওসবের কী বুঝবে, মুসা আমান? ঘোড়া দেখলে ভয় পাও, কুকুর পছন্দ করো না..।
ঘোড়া দেখলে ভয় পাই, তুমি জানলে কী করে? অবাক হয়ে গেছে মুসা।
না, ইয়ে, মানে, যে লোক কুকুর পছন্দ করে না, ঘোড়াকে তো ভয়। সে পাবেই, বলে তাড়াতাড়ি অন্য কথায় চলে গেল জর্জ। ও, হ্যাঁ, চলো, সাঁতার কাটতে যাই। নাকি মাছ ধরবে?
কুকুরটাকে এখন কোথায় রাখো, জর্জ? কিশোর জানতে চাইল।
ফগ-এর কাছে। ওর বাবা জেলে। গরীব, নিজেরাই খেতে পায় না, কুকুরকে খাওয়াবে কোথা থেকে? রাফিয়ানের খরচ আমিই দিই। মাঝে মাঝে ফগকেও কিছু হাতখরচ দিই; রাফিয়ানকে যত্ন করে, সেজন্যে।
টুংটাং টুংটাং ঘণ্টা বেজে উঠল। রাস্তা দিয়ে আইসক্রিমওয়ালা। যাচ্ছে।
আইসক্রিম! এক লাফে উঠে দাঁড়াল মুসা। এই, মিয়া, দাঁড়াও দাঁড়াও! মোটা সাইজের গোটা চারেক চকলেট-আইসক্রিম কিনে নিয়ে এল সে। রবিন আর কিশোরকে দিল একটা করে। জর্জের দিকে বাড়িয়ে ধরতেই ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিল সে।
না, তোমার আইসক্রিম আমি খাব না! ঝঙ্কার দিয়ে উঠল জর্জ। তুমি আমার রাফিয়ানকে গালমন্দ করেছ!
গালমন্দ আবার করলাম কখন! …আচ্ছা, ঠিক আছে, আর করব না। এই, রাফিয়ান, তুইও নে, নিজেরটা বাড়িয়ে ধরল মুসা।
কখন কী গালমন্দ করেছে মুসা, তাতে থোড়াই কেয়ার রাফিয়ানের, গপ করে আইসক্রিমটা কামড়ে ধরে খেতে শুরু করে দিল সে।
নরম হলো জর্জ। আর কক্ষনো বকবে না তো ওকে?
না, বব না। নাও।
আইসক্রিম নিল জর্জ। নিজের জন্যে আরেকটা কিনে নিয়ে এল। মুসা।
নীরবে বসে আইসক্রিম খেল ওরা কিছুক্ষণ।
একসময় জর্জ বলল, সত্যি, তোমরা আসাতে যা খুশি হয়েছি না! চলো, একটা নৌকা নিয়ে আজ বিকেলেই যাই। আমার জাহাজটা দেখবে। কি বলো?
নিশ্চয়ই! প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা।
হুফ! বলে উঠল রাফিয়ান, জোরে জোরে নাড়ছে লম্বা লেজ, তার। মানে সে-ও যেতে রাজি।
চার
ফুড়ৎ করে উড়ে চলে গেল যেন সকালটা। গোটাকয়েক রঙিন মাছ ধরেছে আর ছেড়েছে রবিন। একের পর এক গুলি করে গেছে মুসা, কিন্তু একটা পাখিকেও লাগাতে পারেনি; তার গুলি কোনখান দিয়ে গেছে, টেরই পায়নি পাখি; রেগেমেগে শেষে ঢিল মেরে দুএকটা পাখিকে উড়িয়ে দিয়েছে, জর্জ আর রবিনের টিটকারি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, তবে রাফিয়ান খুব ভাল ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে। পাখি, দেখলেই আলতো হউ করে মুসার কাপড় কামড়ে ধরে টেনে ফিরিয়ে পাখিটা দেখিয়ে দিয়েছে। রীতিমত ভাব হয়ে গেছে এখন দুজনের।
দুপুর হয়ে আসছে। গরম বাড়ছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ছেলেদেরকে নীল সাগর। এয়ারগান ফেলে কাপড় খুলে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসা। তার সঙ্গে সঙ্গেই নামল রাফিয়ান। রবিন আর কিশোরও নামল। কিন্তু আশ্চর্য! জর্জ নামল না। কিছুতেই নামানো গেল না তাকে। সাঁতার কাটার মুড নেই নাকি তার আজ?
দুপুর নাগাদ ছুঁচোর নাচন আরম্ভ হলো ছেলেদের পেটে। বাড়ির পথ ধরল ওরা।
ভেড়ার মাংসের বড়া, আপেলের হালুয়া, ঘরে বানানো দই আর পনির দিয়ে চমৎকার খাওয়া হলো। সব শেষে এল গাজরের মোরব্বা! মুসার হাসি দেখে কে? মিসেস গোবেল বুঝে গেছেন, কে ভোজনরসিক, তাই সেদিকেই তার আনাগোনা বেশি।
বিকেলে কোথায় যাচ্ছ তোমরা? মহিলা সত্যিই ভাল। অল্প সময়েই একেবারে আপন করে নিয়েছেন ছেলে তিনটেকে।
আমাদেরকে তার জাহাজটা দেখাতে নিয়ে যাবে জর্জ, রবিন বলল।
চোখ বড় বড় হলো মিসেস গোবেলের। জাহাজ দেখাতে নিয়ে যাবে জর্জ! বলো কী? এ যে পশ্চিমে সূর্য উঠল রে! কত ছেলেমেয়ে ওকে সাধাসাধি করে করে হয়রান, শেষে আমাকে এসে ধরেছে, আর বলেও কিছু করাতে পারিনি! নিয়ে যায়নি। অথচ…
চুপচাপ খাচ্ছিল জর্জ, বাধা দিয়ে বলে উঠল, ওরা আমার বন্ধু, তাই নিয়ে যাব। আমার ইচ্ছে না হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও নিয়ে যাব না।
হুঁ, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বয়েই গেছে তোর কাছে আসতে!…যাক, তোর যে অন্তত তিনজন বন্ধু জুটেছে, এতেই আমি খুশি। তোর এই গোয়ার্তুমির জন্যে কেউ পছন্দ করে তোকে? তোর বাপ পর্যন্ত দেখতে পারে না।
না না, খালা, হাত তুলল মুসা, আমরা খুব পছন্দ করি ওকে। তা ছাড়া ওর রা…আঁউউ! পায়ে জর্জের প্রচণ্ড লাথি খেয়ে থেমে গেল সে।
কী, কী হলো! ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মিসেস গোবেল।
না, কিছু না-পিঁপড়ে কামড়েছে!
অবাক হয়ে এক মুহূর্ত মুসার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি, তারপর একটা প্লেট টেনে নিয়ে তাতে খাবার তুলতে শুরু করলেন। জর্জের বাবা টেবিলে খেতে আসেননি-স্বস্তিই বোধ করছে ছেলেরা। তার ঘরে তাকে খাবার দিয়ে আসা হবে।
.
খাওয়ার পর আর একটা মিনিটও দেরি করল না ছেলেরা। প্রায় ছুটে চলে এল সৈকতে। কুকুরটাকে আনতে গিয়েছিল যখন, খুব সম্ভব তখনই বলে রেখেছিল জর্জ, নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে ফগ। ওদেরই বয়েসী আরেক। কিশোর রোদে-পোড়া বাদামী মুখের চামড়া, কোকড়ানো বড় বড় চুল। সৈকতে বালির ওপর ডিঙির অর্ধেকটা টেনে তুলে তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে। তার পায়ের কাছে শুয়ে রয়েছে রাফিয়ান, কুকুরটার গায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলাচ্ছে ফগ।