হাঁ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। বলে কী জর্জ!
জোরে মাথা ঝাঁকাল জর্জ। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। জাহাজটা ছিল আমার নানার-নানার-বাবার। সোনা নিয়ে আসছিল ওটা, সোনার বার। গোবেল দ্বীপের কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।
তাই? বারগুলোর কী হলো? চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রবিনের।
কেউ জানে না, মাথা নাড়ল জর্জ। হয়তো চুরি হয়ে গেছে। কোনভাবে। গুপ্তধন শিকারীরা আঁতিপাতি করে খুঁজেছে জাহাজটা, সোনার একটা টুকরোও পায়নি।
মেরেছে! তুড়ি বাজাল মুসা। কতখানি গভীর? ডুব দেয়া যায়? দেখতে ইচ্ছে করছে!
ডুবুরীর পোশাক হলে তো যায়ই, জর্জ বলল। তবে ওপর থেকে দেখতে চাইলে আজই যেতে পারি। বিকেলে। পুরো ভাটা থাকবে তখন, পানি নেমে যাবে অনেক, তা ছাড়া সাগরও শান্ত আজ।
দারুণ হবে! খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল রবিন। দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
কিশোর চুপ করে রয়েছে, আস্তে আস্তে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে, তার মানে গভীর ভাবনা চলেছে তার মাথায়।
তো, জর্জ, মুসা বলল, মাছ ধরার কী হবে? বাড়িতে না বলে এলে, মাছ ধরতে যাচ্ছ?
আগে রাফিয়ানকে ডেকে নিয়ে আসি, জর্জ উঠে দাঁড়াল।
রাফিয়ান? কপাল কুঁচকে গেছে মুসার।
কথাটা গোপন রাখবে তো? বাড়িতে কেউ যেন না জানে।
জানবে না, কথা দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা।
রাফিয়ান আমার সবচে বড় বন্ধু, জর্জ বলল। কিন্তু মা আর বাবা একদম দেখতে পারে না ওকে, কাজেই লুকিয়ে রাখতে হয়। যাই, নিয়ে আসি।
পাহাড়ি পথ ধরে ছুটে চলে গেল জর্জ। অবাক হয়ে চেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। তিনজনেই একমত, সাংঘাতিক রহস্যময় কিশোর জর্জ গোবেল।
ওই রাফিয়ানটা আবার কে? মুসা বলে উঠল।
হবে হয়তো কোন জেলের ছেলে-টেলে, রবিন সন্দেহ করল। জর্জের মা-বাবা তাই দেখতে পারে না।
নরম বালিতে গা ছড়িয়ে পাথরে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করে রইল ছেলেরা। খানিক পরেই বড় একটা টিলার ওপাশে জর্জের গলা শোনা গেল। আরে; আয়, রাফি; জলদি আয়, ওরা বসে আছে!
টিলার মাথায় দেখা গেল জর্জ আর তার বন্ধুকে। পিঠ সোজা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দার। ও, এই তা হলে রাফিয়ান। জেলের ছেলে নয়, মস্ত এক কুকুর, বাদামী রঙের মাংগরল। অস্বাভাবিক লম্বা লেজ, চওড়া মুখে ছড়িয়ে রয়েছে যেন বিস্তৃত হাসি। আনন্দে জর্জের চারপাশ ঘিরে লাফাতে লাফাতে আসছে। ঢাল বেয়ে ছুটে নামছে জর্জ।
এই হলো রাফিয়ান, কাছে এসে পরিচয় করিয়ে দিল জর্জ, হাঁপাচ্ছে। খুব সুন্দর, না? একেবারে নিখুঁত।
ভুল বলেছে জর্জ। মোটেই নিখুঁত নয় রাফিয়ান, বরং খুঁতই বেশি। পিঠ সামান্য কুঁজো, শরীরের তুলনায় অনেক বড় মাথা-মাংগর কুকুরের সাধারণত এমন হয় না, কানের ডগা গোল হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে। চোখা, বড় বড়; লেজটা এত লম্বা, মোটা রোমশ না হলে চিতাবাঘের লেজ বলেই মনে হত। সবকিছু মিলিয়ে মাংগরলের ভয়ঙ্করত্ব নেই চেহারায়, আছে একটা হাস্যকর ভাব; তবে আদর করতে ইচ্ছে করে, এটা ঠিক। প্রথম দর্শনেই তিন গোয়েন্দাকে ভালবেসে ফেলেছে কুকুরটা, তার উন্মাদ নাচ আর অনর্গল গাল-হাত চেটে দেয়া থেকেই বোঝা যায়।
লক্ষ্মী ছেলে! আদর করে রাফিয়ানের নাক চাপড়ে দিল রবিন।
মুসার নাক-মুখ চেটে দিল রাফিয়ান।
আরে, আরে, এই, করছিস কী, কুত্তার বাচ্চা কুত্তা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। অপবিত্র করে দিচ্ছিস! আমার মা দেখলে এখন সাতবার সোনারূপা ধোয়া পানি দিয়ে গোসল করাত! কুত্তা নাকি নাপাক জীব!
কিন্তু নাপাক জীবটা এই কটু কথায় কিছুই মনে করল না, বরং আদর করে পেছন থেকে মুসার কাঁধে দুই পা তুলে দিয়ে হ্যাঁহ্ হ্যাঁহ করে হাসল।
জোরে হেসে উঠল রবিন আর জর্জ।
ইস, ওরকম একটা কুকুর যদি থাকত আমার! কিশোর আফসোস করল। এই, রাফিয়ান, এদিকে আয়।
এক লাফে কিশোরের প্রায় কোলে এসে পড়ল রাফিয়ান।
আন্তরিক হাসি ফুটল জর্জের মুখে, জ্বলজ্বল করে উঠল তামাটে চোখের তারা। হাত-পা ছড়িয়ে ধপ করে কিশোরের পাশে বালিতে বসে পড়ল। বাহ, আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ইচ্ছে নাকি? কটাক্ষ করল সে। রাফিয়ানকে ভীষণ ভালবাসি আমি। জানো, মাত্র এক বছর বয়েস ওটার, অথচ কত বড় হয়ে গেছে! জলার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, গত বছর। চেহারা ভাল না বলেই বোধহয় ফেলে দিয়ে এসেছিল ওকে ওর মালিক। বাড়ি নিয়ে এলাম। প্রথমে মা কিছু মনে করেনি। কিন্তু যতই বড় হতে লাগল, দুষ্টুমি বেড়ে গেল রাফিয়ানের, শেষে মা আর সইতে পারল না…
কী দুষ্টুমি করত? রবিন জানতে চাইল।
যা পেত তা-ই চিবাত। ড্রইংরুমের নতুন কার্পেটের কোনা চিবিয়ে দিয়েছে নষ্ট করে, মার একটা নতুন হ্যাট কামড়ে অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে। বাবার স্যাণ্ডেল আর কাগজ চিবাতে গিয়েই পড়ল বিপদে। ধরে আচ্ছামত ধোলাই লাগাল বাবা। তারপর থেকেই বাবাকে দেখতে পারে না। ঘেউ ঘেউ করে কামড়াতে যায়। এই কাণ্ড করলে কি আর বাড়িতে রাখা যায় ওকে? শেষে দিল একদিন বাড়ি থেকে বের করে। বাবা হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, এরপর আর ওকে বাড়িতে নিয়ে গেলে আমাকে সুদ্ধ বের করে দেবে।
হ্যাঁ, তোমার বাবাকে দেখলেই ভয় করে, মুসা মাথা দোলাল। সারাক্ষণই যেন রেগে আছে!
সাগরের দিকে চোখ ফেরাল জর্জ। বাবা ওরকমই! রাফিয়ানকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পর কত কেঁদেছি, কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি, না খেয়ে থেকেছি, কেয়ারই করল না বাবা। সাফ জবাব, কুকুর বাড়িতে ঢোকানো যাবে না। আমার দুঃখে রাফিয়ানও কেঁদেছে।