নাশতা শেষ হলো। মুখ তুলল জর্জ। এই প্রথম কথা বলল ছেলেদের সঙ্গে, আমি মাছ ধরতে যাব। তোমরা? মেয়েলী কণ্ঠস্বর। চেনা চেনা।
আমরাও যাব, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা। তুমি না গেলেও যেতাম। ছিপ নিয়ে এসেছি আমরা। কাটা কাটা জবাব। এ হাসল জর্জ। কেমন যেন পরিচিত হাসিটা, সামনের দুটো দাঁত সামান্য উঁচু না হলে খুব মিষ্টি দেখাত। খুব রেগে গেছ, না? চলো, উঠে। পড়ি। বাবা এসে দেখে ফেললে হয়তো অন্য কাজে লাগিয়ে দেবে। কিংবা ঘরে আটকে দেবে।
মিসেস গোবেলকে বলে জর্জের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। রবিনের হাতে ছিপ, মুসার হাতে এয়ারগান,, কিশোরের কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা।
সৈকতের ধার ধরে এগিয়ে চলল ওরা। দিগন্তের ওপরে অনেকখানি উঠে পড়েছে সূর্য, সাগরের সোনালি পানি নীল হতে আরম্ভ করেছে, ঝলমল করছে কাঁচা রোদে।
হাঁটতে হাঁটতেই হাত তুলে একটা দ্বীপ দেখাল জর্জ। কেমন যেন অদ্ভুত, পাথুরে দ্বীপ। এক পাশ থেকে একটা সরু প্রণালী বেরিয়ে মিশেছে। সাগরের সঙ্গে। দ্বীপের মাঝে একটা উঁচু টিলার ওপরে ভাঙা কিছু দালানকোঠা, অনেক পুরানো কোন দুর্গের ভগ্নাবশেষ বোধহয়। সুন্দর জায়গা, না?
হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর আর রবিন।
ওটার নাম গোবেল দ্বীপ, কিশোরের দিকে ফিরল জর্জ, তার তামাটে চোখে নীল সাগরের প্রতিফলন। খুবই সুন্দর জায়গা। একদিন। তোমাদেরকে নিয়ে যাব ওখানে। কবে, এখনি বলতে পারছি না।
কোথায় শুনেছে ওই মেয়েলী কণ্ঠস্বর? ওই চোখ কোথায় দেখেছে? মনের অলিগলিতে আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে রবিন, কিন্তু জবাব মিলছে না।
গোবেল দ্বীপ! বিড়বিড় করল কিশোর। কাদের ওটা? তোমাদের?
আমার, হাসল জর্জ। মানে, আমারই হবে একদিন। ওই দ্বীপ, দুর্গ।
তিন
ক্ষণিকের জন্যে থ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
ওই দ্বীপ! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা। আস্ত একটা দ্বীপ তোমার!
বললাম না, একদিন হবে, হাসছে জর্জ। বিশ্বাস না হলে মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। দ্বীপটা এখন মায়ের, তার মানে, আমারই তো?
হুঁ! হলেই বা কী? আপনমনেই বলল মুসা। কালো কালো সব পাথর। নারকেল বীথি নেই, বনবাদাড় নেই। আসলে, প্রবালদ্বীপ হলো সবচেয়ে সুন্দর।
ওটাও সুন্দর, জোর গলায় বলল জর্জ। গেলেই বুঝবে। অসংখ্য খরগোশ আছে, আর কমোরেন্ট। সী-গালের তো ঝাক পড়ে একেক সময়। এয়ারগান দিয়ে আর কটা মারবে? দুৰ্গটাও এককালে খুব সুন্দর ছিল। এখন ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে, তা-ও সুন্দর।
যত যা-ই বলো, আমার কাছে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। সাফ জবাব দিল। মুসা।
ভূত আছে ভাবছ নাকি? তোমাদের সেই টেরর ক্যাসলের ভূত?
তুমি কী করে জানলে? ঝট করে ফিরল রবিন।
জানি জানি, রহস্যময় হাসি হাসল জর্জ। আরও অনেক কিছুই। জানি। তোমাদের নাড়িনক্ষত্র সব জানা আছে আমার।…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দ্বীপটা সুন্দর। আরেকটা ব্যাপার, ভূত নেই, তবে গুপ্তধন থাকতে পারে।
মানে? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
চলো, কোথাও গিয়ে বসি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে জর্জ। লম্বা কাহিনী। ওই যে, ওই পাথরগুলোর ওপর গিয়ে বসি, চলো।
কোন্খান থেকে শুরু করি? একটা পাথরে বসতে বসতে বলল। জর্জ। হ্যাঁ, অনেক আগে এখানকার প্রায় সমস্ত জায়গা ছিল আমার মায়ের পূর্বপুরুষদের। যতই দিন গেল, ধীরে ধীরে গরীব হয়ে পড়ল। তারা, সমস্ত জায়গাজমি বেচে বেচে খেল। কিন্তু ওই ছোট্ট দ্বীপটা বেচেনি, কিংবা হয়তো কেনার লোক পায়নি, তাই বেচতে পারেনি। কে কিনবে? ওই ভাঙা দুর্গ দিয়ে কার কী হবে?
ভালই হয়েছে। চমৎকার ওই দ্বীপটার এখন মালিক হব আমি।…দ্বীপটা ছাড়াও আরও কিছু মাকে দিয়ে যেতে পেরেছে আমার নানা, বাড়িটা, গোবেল ভিলা। ভেঙেচুরে গিয়েছিল, বাবা অনেক খরচাপাতি করে সারিয়ে নিয়েছেন। দুৰ্গটা বাবার কোন কাজে লাগছে না, নইলে সারিয়ে নিত।
জর্জকে ঘিরে বসেছে তিন গোয়েন্দা। আগ্রহ নিয়ে শুনছে তার কথা।
হুঁ, দ্বীপটা সুন্দরই! কিশোর বলল। মালিক হতে পারলে, আমিও তোমার মতই খুশি হতাম।
হ্যাঁ, এখানকার অনেক ছেলেমেয়েই সেকথা বলে, দ্বীপটা তাদের ঈর্ষার বস্তু। কতবার কতজন সাধাসাধি করেছে আমাকে, ওখানে নিয়ে যেতে। যাইনি। রেগে গিয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছে, বড় লোক বলে আমি নাকি অহঙ্কারে বাঁচি না। হিহ!
দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে আছে চারজনেই। ভাটার টানে পানি নেমে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে দ্বীপটা।
ওরা নিজে নিজে চলে গেলেই তো পারে? বলল কিশোর।
এত সহজ না, মাথা নাড়ল জর্জ। নৌকা ছাড়া যাওয়ার পথ নেই। পথ চেনা না থাকলে নৌকা নিয়ে গেলেও বিপদে পড়তে হবে। প্রণালীটার জায়গায় জায়গায় ভীষণ গভীর, কিন্তু বেশির ভাগ জায়গাই অগভীর, চোখা সব পাথর বেরিয়ে আছে কোথাও পানির ওপরে, কোথাও পানির নিচে। নৌকার তলায় ঘষা লাগলেই সর্বনাশ। চিরে, কেটে ফালাফালা হয়ে যাবে। তারপর সাতরে তীরে ওঠা! অসম্ভব! কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলে বাড়ি লেগে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
ডুবে যাওয়া জাহাজ! চকচক করছে কিশোরের চোখ। আছে নাকি ওখানে!
এক কালে অসংখ্য ছিল, জর্জ বলল। এখন সাফ করে ফেলা হয়েছে, করেছে গুপ্তধন শিকারীরা। তবে ছোটখাট একটা-দুটো যে এখনও নেই তা নয়। আর বড় একটা আছে, দ্বীপের ওপাশে। গভীর পানিতে। সাগর শান্ত থাকলে নৌকো থেকে নিচে তাকালে ওটার ভাঙা মাস্তুল চোখে পড়ে, তার নিচে অন্ধকার, আর কিছু দেখা যায় না। মিটিমিটি হাসছে সে। ওই ভাঙা জাহাজটাও আমার।