রাফিয়ান! জিনার গলা কাঁপছে। ও তো নিচে রয়ে গেছে!
ওর জন্যে ভাবনা নেই, মুসা অভয় দিল। ও নিরাপদেই থাকবে। লুকিয়ে রেখে এসেছি। এসো, যাই!
তোমরা যাও, আমি আসছি, বলেই পাথরের ঘরটা, যেতে মালপত্র রাখা আছে, সেদিকে দৌড় দিল কিশোর।
কোথায় গেল! জিনা অবাক।
নিশ্চয় কোন কাজ আছে! চলো, চলো! তাড়া দিল রবিন, দৌড় দিল নৌকার দিকে।
লাফিয়ে নৌকায় উঠল জিনা আর রবিন। মোটরবোটের পাটাতনে দাঁড় দুটো আবিষ্কার করল মুসা। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি! দাঁড় পেয়েছি!
কিশোর এসে পড়েছে, হাতে কুড়াল।
ওটা দিয়ে কী হবে? জানতে চাইল জিনা।
জবাব দিল না কিশোর। লাফিয়ে উঠে পড়ল মোটরবোটে। ধাই করে কুড়াল বসিয়ে দিল তেলের ট্যাঙ্কে। একের পর এক কোপ মেরে চলল সে, যেন পাগল হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে একেবারে অকেজো করে দিল ইঞ্জিন, আর কয়েক কোপে বোটের তলা খসিয়ে দিয়ে লাফিয়ে নামল তীরে। ছুটে এসে লাফিয়ে উঠল নৌকায়। জলদি নৌকা ছাড়ো, জিনা!
প্রণালীর মাঝামাঝি চলে এসেছে নৌকা, এই সময় পাহাড়ের মাথায় লোক তিনজনকে দেখা গেল। ঢাল বেয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামল। ওরা, বোটের কাছে এসে থমকে গেল। মুঠো পাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল জেরি, বিচ্ছুর গোষ্ঠী। দাঁড়াও, আগে ধরে নিই, তারপর দেখাব মজা!
জিনার তামাটে চোখে আলোর ঝিলিক। কী করে দেখাবে? আগে আমাদের কাছে আসতে হবে তো?
তীরে দাঁড়িয়ে নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসতে থাকল লোকগুলো, মুঠো পাকিয়ে দেখাচ্ছে আর গাল দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কী-ই এসে যায় গোয়েন্দাদের!
জিনা অবশ্য আনন্দে পুরোপুরি সামিল হতে পারছে না। রাফিয়ানের জন্যে ভাবছে।
মুসা বলল, আরে, বাবা, এত ভাবছ কেন? নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল, এই মুসা আমানের ওপর আরেকটু ভরসা রাখো না। আমি বলছি, আমাদের রাফিয়ান নিরাপদেই আছে। ভরপেট খেয়ে নিশ্চয় এখন সে সুখস্বপ্ন দেখছে!
সতেরো
খোলা সাগরে বেরিয়ে এল নৌকা। এখান থেকে ছোট বন্দরটা দেখা যায় না, লোক তিনজনকেও চোখে পড়ছে না। মাছধরা জাহাজের রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে এক খালাসী। ছেলেদেরকে দেখে ডাকল, এইই, তোমরা দ্বীপ থেকে এসেছ?
জবাব দিয়ো না, নিচু গলায় বলল কিশোর।
সবাই চুপ করে রইল।
এই, ছেলেরা, আবার ডাকল লোকটা, তোমরা দ্বীপ থেকে এসেছ? গোবেল দ্বীপ?
এবারেও সবাই চুপ। তাকালও না মুখ তুলে।
এই, জবাব দিচ্ছ না কেন? ধমকে উঠল লোকটা।
তবুও কথা বলল না ছেলেরা, যেন কানেই যাচ্ছে না লোকটার কথা।
লোকটা শিওর হয়ে গেল, ছেলেগুলো দ্বীপ থেকেই এসেছে। ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল, নিশ্চয় সন্দেহ করেছে, সব কিছু ঠিকঠাকমত ঘটেনি দ্বীপে, কোন গণ্ডগোল হয়েছে। তাড়াতাড়ি ডেক থেকে নিচে নেমে গেল সে।
যদি আমাদেরকে ধরতে আসে? মুসার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
আসবে না, কিশোর বলল। নৌকা নামিয়ে প্রথমে দ্বীপে দেখতে যাবে কী হয়েছে। আমি হলে তাই করতাম। তারপর হয়তো আমাদের ধরার চেষ্টা করবে।
করলেও আর পেরেছে! মুখ বাঁকাল জিনা। ততক্ষণে আমরা পগার পার।
কিন্তু সোনাগুলো তো নিয়ে যেতে পারবে, রবিন বলল।
তা-ও পারবে না, মাথা নাড়ল কিশোর। নৌকা নিয়ে লোকটা দ্বীপে যাবে, বন্দরটা খুঁজে বের করবে, সঙ্গীদের কথা শুনবে, সোনাগুলো বের করে এনে নৌকায় তুলবে, অনেক সময়ের ব্যাপার। এত সময় নেই ওদের হাতে। জানে, যে-কোন মুহূর্তে পুলিশের বোট নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারি আমরা।
.
জিনার মা-বাবাকে পরিস্থিতি বোঝাতে বিশেষ সময় লাগল না। থানায় ফোন করলেন মিস্টার পারকার। পুলিশের পেট্রল বোটে করে ছেলেদের সঙ্গে তিনিও চললেন দ্বীপে।
প্রণালীর কাছে মাছধরা জাহাজটা নেই, দিগন্তের কোথাও দেখা গেল না ওটা। লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
বোট থেকে ডিঙি নামিয়ে প্রণালী দিয়ে ছোট বন্দরে চলে এল ওরা। তেমনিভাবে পড়ে রয়েছে মোটরবোটটা, অর্ধেকের বেশি পানির তলায়।
তবে, সোনার বার সব নেই, বেশ কিছু গায়েব। একেবারে খালি হাতে যায়নি ডাকাতেরা। যা পেরেছে নিয়ে গেছে। এখনও যা রয়েছে, অনেক, কয়েক কোটি টাকার তো হবেই।
কিন্তু এসবের প্রতি নজর নেই জিনার, মুসাকে নিয়ে আগে রাফিয়ানকে উদ্ধার করতে চলল সে।
একটা ছোট ঘরে এসে ঢুকল মুসা। এক ধারে দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে। বড় একটা পাথর, সেটাকে ঠেকা দিয়ে জায়গামত রাখার জন্যে আরও পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। পাথরগুলোর ওপর দেয়ালে চক দিয়ে একটা কুকুরের মুখ আঁকা। সেদিকে দেখিয়ে হাসল মুসা। চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।
প্রথমে কিছু বুঝল না জিনা, তারপর হেসে ফেলল। নাহ, যতটা ভেবেছিলাম, তত বোকা তুমি নও, মুসা।
দুজনে মিলে পাথর সরিয়ে দেয়ালের খোড়ল থেকে রাফিয়ানকে বের করল। নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তই হলো রাফিয়ান। কিশোর আর জিনাকে যে খাবারগুলো দিয়ে গিয়েছিল তোক দুটো, ওগুলো সব খেয়ে পেট ভারি হয়ে গেছে তার, আরাম করে শুয়ে খুব একচোট ঘুমিয়ে নিয়েছে। চুপচাপ থাকতে অনুরোধ করেছিল তাকে মুসা, বোধহয় অনুরোধ রেখেছে, টু শব্দটি করেনি রাফিয়ান, নইলে ডাকাতদের হাতে পড়ত, প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে হয়তো মেরেই রেখে যেত ওরা।
.
সিঁড়িমুখের কাছে অপেক্ষা করছেন মিস্টার পারকার। নিচে ডাকাতদেরকে খোঁজাখুঁজি করছে পুলিশ; জানে, পাবে না, তবুও করছে, রুটিন চেক।