হয়তো! জিনা বলল। কিন্তু মুসা বেরোবে কী করে?
হাসল কিশোর। যে পথে ঢুকে বের করে এনেছে আমাদের। আমিই যেতাম, কিন্তু কাজটা আমার চেয়ে মুসা অনেক ভাল পারবে। যার কাজ তাকেই সাজে, সে-ই যাক। কি, মুসা, আপত্তি আছে?
আপত্তি? হাসল মুসা। কুয়াটা এখন ডালভাত হয়ে গেছে আমার কাছে। তিনবার নেমেছি আর উঠেছি। আরেকবারে কিছু হবে বলে মনে হয় না। একটু থেমে বলল, আমিই নামব তুমি ওপরে থাকো। আমি আটকা পড়লে অন্যদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তোমাকে দরকার। তা ছাড়া ওপরে আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে; সেসব তুমিই সামাল দিতে পারবে, আমি পারব না। বেকায়দায় পড়লে ভেউ ভেউ করে কান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারব না আমি…
বাহ, বাহ, আমাদের মুসা আমান আজকাল বিনয়ের অবতার হয়ে গেছেন! হেসে টিপ্পনী কাটল রবিন।
সবাই হাসল।
আর খানিক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো, মুসাই নামবে।
ঘর থেকে খাবার এনে পাহাড়ের মাথায় বসে খেল ওরা। চোখ সাগরের দিকে।
ঘণ্টা দুয়েক পর একটা বড় মাছধরা জাহাজ দেখা গেল, দ্বীপের দিকেই আসছে। প্রণালীর মুখের কাছ থেকে দূরে থেমে গেল।
আসছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। মুসা, জলদি, গিয়ে ঢোকো!
ছুটে চলে গেল মুসা।
অন্যদের দিকে ফিরল কিশোর। জোয়ার আসতে দেরি আছে। নিচে, ওই যে ওই পাথরগুলোর আড়ালে লুকানো যাবে এখন।
লুকিয়ে পড়ল সবাই। কানে আসছে বোটের ইঞ্জিনের ভারি ঝকঝক ঝকঝক! বন্দরে নোঙর করল বোট, লোকের কথা শোনা গেল, দুজন নয়, বেশি। পাহাড় বেয়ে ওদের উঠে যাওয়ার শব্দও কানে এল।
আস্তে করে মাথা উঁচু করে উঁকি দিল কিশোর। লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় চত্বরে উঠে গেছে। চাপা গলায় সঙ্গীদেরকে ডাকল, এই, বেরিয়ে এসো!
পাহাড়ের ওপরে কতগুলো পাথরের স্কুপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ওরা। এখান থেকে চত্বরের অনেকখানি চোখে পড়ে, সিঁড়িমুখটাও।
কাউকে দেখা গেল না। সিঁড়িমুখের পাথর ইতস্তত ছড়ানো।
ঢুকে পড়েছে! এসো! পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল কিশোর। পেছনে অন্যরা।
প্রায় নিঃশব্দে সিঁড়িমুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। মস্ত একটা চ্যাপ্টা পাথর পড়ে আছে, ওটা দিয়েই মুখ ঢাকা হয়েছিল। সরানো হয়েছে। ওটাকে আবার সিঁড়িমুখে ফেলতে হবে।
ঠেলতে শুরু করল ওরা। বেজায় ভারি পাথর। তিনটে ছেলেমেয়ের জন্যে বেশিই। গলদঘর্ম হয়ে উঠল, জিভ বেরিয়ে পড়ল, হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে পাথর সরাতে গিয়ে। কিন্তু নড়তে চাইছে না জগদ্দল পাথর, গ্যাট হয়ে বসে আছে।
বোঝা গেল, ওটা সরানোর সাধ্য ওদের নেই। শেষে আরেকটু ছোট তিনটে পাথর দিয়ে কোনমতে মুখটা বন্ধ করে এসে কুয়ার পারে বসে হাঁপাতে লাগল। কী জানি করছে মুসা নিচে, আল্লাহ মালুম! কিশোর বিড়বিড় করল।
অনেক কিছুই করেছে মুসা, এখন লুকিয়ে বসে আছে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গে। আরেকটা সুড়ঙ্গে কথা বলার আওয়াজ শুনল সে, কান পেতে রইল। একটু পরেই সুড়ঙ্গের মুখে আলো দেখা গেল। কথা বলতে। বলতে বেরিয়ে এল তিনজন লোক।
তিনজন! সর্বনাশ হয়েছে! পরিকল্পনা আর কাজে লাগানো যাচ্ছে না!–শঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা।
ওই যে, ওই দরজাটাই, হাত তুলে দেখিয়ে বলল ভারি কণ্ঠ। ওতেই রয়েছে সোনার বারগুলো। ছেলেমেয়ে দুটো, আর কুত্তাটাও।
হ্যাঁ, তাই ভাবতে থাকো, ইবলিসের বাচ্চারা! মনে মনে হাসল মুসা। আছে তোমাদের জন্যে বসে, বসে বসে আঙুল চুষছে, দেখো
ছিটকিনি খুলল লোকটা। পাল্লা ঠেলে খুলে ঢুকে পড়ল। তার পিছনে ঢুকল আরেকজন। তৃতীয় লোকটা বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল ভিতর থেকে, জেরি, ওরা নেই!
লাফ দিয়ে উঠল বাইরে দাঁড়ানো লোকটা, ছুটে ঢুকে পড়ল।
বিদ্যুৎ খেলল মুসার শরীরে, চোখের পলকে ছুটে এসে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। ঠেলেঠুলে লাগিয়ে দিল নিচের ছিটকিনি।
কিন্তু দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচল হয়ে উঠল ভিতরের লোকগুলোও। সব শেষে ঢুকেছে যে লোকটা, জেরি, কাধ দিয়ে জোরে ধাক্কা মারল দরজায়। মুসা সবে তখন নিচের ছিটকিনিটা লাগিয়েছে। থরথর করে কেঁপে উঠল দরজা। সে ওপরের ছিটকিনিটা লাগানোর আর সময় পেল না, তার আগেই এক যোগে এসে তিনজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল পাল্লায়; সইতে পারল না পুরানো ছিটকিনি; আংটা ছিঁড়ে ছুটে খুলে গেল ওটা। খুলে গেল দরজা।
ছুট দিল মুসা। ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। পেছনে তাড়া করে এল লোকগুলো।
কুয়াঘরে চলে এল মুসা। সুড়ঙ্গের ভিতরে লোকগুলোর হৈ-চৈ শোনা যাচ্ছে। মুহূর্ত দ্বিধা না করে ফোকরে মাথা ঢুকিয়ে দিল সে। দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল কুয়ায়। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে, ওই অবস্থায়ই দড়ি বেয়ে উঠে চলল। আশা করছে, ফোকরটা লোকগুলোর চোখে পড়লেও কিছু বুঝতে পারবে না। কারণ ওরা জানে না কুয়াটার অস্তিত্ব।
আটকে থাকা পাথরটার কাছে এসে হাত থেকে মই প্রায় ছুটেই যাচ্ছিল মুসার। ধড়াস করে বোয়াল মাছের মত এক লাফ মারল হৃৎপিণ্ড। ঘামে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে হাত। অবশ হয়ে আসছে শরীর, পরিশ্রমে, উত্তেজনায়।
অবশেষে নিরাপদেই বেরিয়ে এল মুসা। উদ্বিগ্ন বন্ধুদেরকে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, হয়নি! পারলাম না!
যা বোঝার বুঝে নিল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি, দৌড় দাও। নৌকার দিকে! আর কোন উপায় নেই!